রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাওলানা ইউসুফ – হত্যা নির্যাতনের অসংখ্য অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে
আজাদুর রহমান চন্দন/প্রতীক ইজাজ
জামায়াতে ইসলামীর নতুন ভারপ্রাপ্ত আমির মাওলানা আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফ একজন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী। একাত্তরে তিনিই প্রথম খুলনায় প্রতিষ্ঠা করেন রাজাকার বাহিনী। শান্তি কমিটিরও তিনি ছিলেন খুলনা জেলার আহ্বায়ক। তারই নেতৃত্বে পরিচালিত হতো সেখানকার নয়টি প্রধান নির্যাতন সেল। রাজাকার বাহিনীর ৯৬ ক্যাডার মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাস সেসব সেলে পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পরে মানুষদের ওপর। সেখান থেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হতো শহরের প্রধান চারটি স্থানে।
মাওলানা একেএম ইউসুফ খুলনায় রাজাকার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে নেতৃত্বে দেওয়ার পাশাপাশি দেশ-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার দায়িত্বও পালন করেন। ডা. মালেক মন্ত্রীসভার সদস্য হিসেবে তিনি পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে গণহত্যা ও যুদ্ধপরাধে সক্রিয় সহযোগিতা দেন। ওই কুখ্যাত মন্ত্রীসভায় তিনি ছিলেন রাজ মন্ত্রী।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আইনের অধীনে যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয় ইউসুফের। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দালালি করার অভিযোগে ’৭২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে মালেক মন্ত্রীসভার সদস্য ও রাজনৈতিক নেতাসহ ৩৭ হাজার ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। আদালতের রায়ে অন্য অনেকের সঙ্গে যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয় একেএম ইউসুফের। কিন্তু পরে সরকারের সাধারণ মা ঘোষণার আওতায় সে বছরের ৫ ডিসেম্বর মুক্তি পান মাওলানা ইউসুফ।
গ্যাটকো দুর্নীতির মামলায় গত রোববার জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী গ্রেফতার হওয়ার পরদিন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মাওলানা আবুল কালাম ইউসুফকে দলের ভারপ্রাপ্ত আমির নির্বাচিত করা হয়। কুয়েত থেকে দেশে ফিরে বুধবার তিনি দায়িত্ব নিয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বসেন। তার বাড়ি বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার রাজৈর গ্রামে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় খুলনা জামায়াতের নেতা ছিলেন তিনি। খুলনা জেলা শান্তি কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে ওই সময় তার নাম ছাপা হয় পাকিস্তান অবজারভারসহ বিভিন্ন পত্রিকায়।
ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির তৈরি ‘গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে প্রত্য অথবা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের তালিকা’য় একেএম ইউসুফের নাম উঠে এসেছে। ১৯৭২ সালে দালাল আইনে গ্রেফতার হওয়া মালেক মন্ত্রীসভার অপর এক সদস্য দালালির অভিযোগে মাওলানা ইউসুফের জেল খাটার সত্যতা স্বীকার করেছেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীবিরোধী গণআন্দোলনের সময় কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের ’৯৪ সালের ২৬ মার্চ প্রকাশিত দ্বিতীয় দফার তদন্ত প্রতিবেদনে ৮ যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে মাওলানা ইউসুফের নাম পাওয়া গেছে।
মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দলিলপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, একাত্তরের মে মাসে মাওলানা ইউসুফই দেশে প্রথম জামায়াতের ৯৬ জন ক্যাডার নিয়ে খুলনায় রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। খুলনার তৎকালীন ভূতের বাড়ি (বর্তমানে আনসার ক্যাম্পের হেড কোয়ার্টার) ছিল তার রাজাকার বাহিনীর হেড কোয়ার্টার এবং প্রধান নির্যাতন সেল। দুটি প্রধান নির্যাতন সেল ও রাজাকার বাহিনীর ক্যাম্প ছিল বর্তমান শিপইয়ার্ড ও খালিশপুরে। এছাড়া পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর মহৃল ক্যাম্প সার্কিট হাউস এবং পাকিস্তানি বাহিনীর অপর চারটি ঘাঁটি হেলিপোর্ট, নেভাল বেস, হোটেল শাহিন ও আসিয়ানা হোটেলও হয়ে উঠেছিল এই বাহিনীর নির্যাতন সেল। প্রথম তিনটি নির্যাতন সেল পরিচালিত হতো সরাসরি রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্বে আর পাকিস্তানি বাহিনীর অবশিষ্ট চারটি ঘাঁটি যৌথভাবে পরিচালিত হতো। তবে অধিকাংশ হত্যাকান্ডই সংঘটিত হয়েছে গঙামারি, সার্কিট হাউসের পেছনে ফরেষ্ট ঘাঁটি, আসিয়ানা হোটেলের সামনে ও স্টেশন রোডসহ কিছু নির্দিস্ট স্থানে।
কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে গঠিত গণআদালতের কাছে প্রত্যদর্শীরা একাত্তরে খুলনায় মাওলানা ইউসুফের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীর নানা যুদ্ধাপরাধের বিবরণ তুলে ধরেন। এদেরই একজন শহীদ আবদুর রাজ্জাকের মা গুলজান বিবি কমিশনকে জানান, একাত্তরের আষাঢ় মাসের একদিন রাজাকার খালেক মেম্বার তার ছেলে রাজ্জাককে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে বলে। রাজ্জাক তা প্রত্যাখ্যান করলে সে মাসের ১১ তারিখ সকালে খালেক মেম্বার ও অপর রাজাকার আদম আলী পুনরায় বাসায় এসে রাজ্জাককে ধরে নিয়ে যায়। সেদিন সন্ধ্যায় গুলজান বিবি জানতে পারেন তার ছেলেকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ছেলেকে ছাড়িয়ে আনার জন্য মা গুলজান বিবি রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা একেএম ইউসুফের কাছে যান এবং তার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে করজোড়ে অনুরোধ জানান। সে সময় মাওলানা ইউসুফের সঙ্গে খালেক মেম্বারও ছিল। তারা দু’জনই জানিয়ে দেন, রাজ্জাককে ছাড়ানোর ব্যাপারে কোনো অনুরোধেও কাজ হবে না। পরে গুলজান বিবি তার ছেলেকে আর পাননি। সন্ধান পাননি লাশেরও।
কমিশনের কাছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রত্যদর্শীরা আরো জানান, মাওলানা ইউসুফের কথামতো খালেক মেম্বার ও আদম আলীর মতো আরো কয়েকজন রাজাকার সে সময় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পরে আরো অসংখ্য নারী-পুরুষকে হত্যা করেছে এবং নারী ধর্ষণ করেছে। রাজাকার বাহিনী গঠনের পর মাওলানা ইউসুফ মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা থেকে বহু লোককে জোর করে ধরে নিয়ে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করেছিলেন। যারা রাজি হননি, তাদের মেরে ফেলা হয়েছে। অনেকের লাশও পাওয়া যায়নি। এসব প্রত্যদর্শী প্রাণভয়ে তাদের নাম প্রকাশে অনীহা জানান।
মাওলানা ইউসুফের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকান্ডের অসংখ্য দলিল ও প্রমাণপত্র ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির কাছে রয়েছে বলে কমিটির আহ্বায়ক ডা. এমএ হাসান সমকালকে জানান। তিনি বলেন, ‘মাওলানা ইউসুফের যুদ্ধাপরাধের দালিলিক প্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে। সে সময় তিনি জামায়াতের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। মন্ত্রিসভায় জামায়াতের যে গুরুত্বপূর্ণ দুই সদস্যকে অন্তর্ভু্ক্ত করা হয়, তাদের মধ্যে মাওলানা ইউসুফ ছিলেন একজন। এখনো তিনি জামায়াতের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি প্রায়ই কুয়েত, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পড়ে থাকেন। কারণ দেশে দলসহ জঙ্গি কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য মুসলিম দেশগুলো থেকে মহৃলত তিনিই অর্থ সংগ্রহ করে থাকেন।’
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দালাল আইনের অধীনে মাওলানা ইউসুফের দন্ডাদেশ এবং জেলখাটার সত্যতা স্বীকার করেছেন মালেক মন্ত্রীসভার অপর এক সদস্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সদস্য জানান, ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে তাকে ও মাওলানা ইউসুফসহ মন্ত্রীসভার সবাইকে ’৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। দালাল আইনের অধীনে আদালত তাকেসহ অন্য অনেকের সঙ্গে মাওলানা ইউসুফকেও যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন। মাওলানা ইউসুফ হাইকোর্টে আপিলও করেছিলেন। কিন্তু তার রায় বেরুনোর আগেই তৎকালীন সরকারের সাধারণ মা ঘোষণার আওতায় তারা সবাই মুক্তি পেয়ে যান। কিন্তু মাওলানা ইউসুফ কি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় পড়েন এ প্রশ্নের উত্তরে মালেক মন্ত্রীসভার ওই সদস্য আরো বলেন, তখন তার বিরুদ্বে এতসব প্রমাণপত্র উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি বলেই তিনি মুক্তি পান।
এসব বিষয়ে মতামত জানার জন্য গতকাল শুত্রক্রবার জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার মোবাইল ফোনে বারবার চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি।
’৭১ সালের ১০ অক্টোবর খুলনার জনসভায়, ২৬ অক্টোবর সিলেটের জনসভায়, ১২ নভেম্বর সাতক্ষীরার রাজাকার শিবির পরিদর্শনকালে এবং ২৮ নভেম্বর করাচিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালেসহ বিভিন্ন সময় তার বক্তৃতা-বিবৃতিতে স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থানের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এসব বক্তৃতা-বিবৃতি পরেরদিন দৈনিক বাংলার বাণী, দৈনিক সংগ্রামসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।