দি টাইমস, ২৯ নভেম্বর, ১৯৭০
ম্যক্সওয়েল ব্রেম
অনুবাদ: ফাহমিদুল হক
পাকিস্তানে ঘূর্ণিঝড়ে কি ২০০,০০০ লোক মারা গিয়েছে — যেমন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছেন? অথবা ১০ লাখ — ঘটনাস্থলে উপস্থিতরা যেমন বলছেন? অথবা ২০ লাখ? এসব হল অনুমানের খেলা, যা কোনো কাজে আসে না। বর্তমানে সত্যিকারের প্রশ্ন হলো ত্রাণ বিতরণ এবং বন্যা-উপদ্রুত ব-দ্বীপকে আবার আগের অবস্থায় নিয়ে যাবার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিশ্রম করা যাবে কি না এবং দু’সপ্তাহ আগের দুর্যোগে যারা বেঁচে গিয়েছে তাদের রক্ষা করা যাবে কি না। বেঁচে যাওয়াদের সংখ্যা হবে দুই মিলিয়ন — সংখ্যাটি নির্ভর করছে মৃত্যুর পরিমাণের ওপর। তাদের চোখে এখন অসহায়ত্বের চিহ্ন।
গতকাল বিকেলে আমি হেলিকপ্টার যোগে গত ১২ নভেম্বরের জলোচ্ছ্বাসে আক্রান্ত একটি বৃহত্তম দ্বীপ হাতিয়ায় গিয়েছিলাম। বিরাণ সেই ভূখণ্ডে এখনও গবাদিপশু ও মানুষের মৃতদেহের স্তূপ। এখানে সেখানে জীবিতদের দল গাছের নিচে ভিড় করে আছে। তাদের কেউ কেউ ধাবমান জলের দেয়ালের হাত থেকে বাঁচার জন্য গাছে উঠেছিলো। এর ফলে জীবিতদের মধ্যে নারী ও শিশুদের চাইতে শক্ত-সমর্থ পুরুষদের সংখ্যা বেশি।
আমার হেলিকপ্টারটি ছিলো ফরাসী। ওইতে নামের হেলিকপ্টারটি সৌদি আরব থেকে এসেছে। এটি হলো ব্রিটেনসহ আট জাতির সমন্বিত সাহায্যকারী এয়ার-লিফটের একটি, জীবিতদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য যাদের প্রাথমিক পর্যায়ের ত্রাণকার্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। বহির্বিশ্ব থেকে প্রায় প্রতি ঘণ্টায় প্লেন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় খাবার, কাপড়, পানি পরিশোধক যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে আসছে। পাকিস্তানের সৈন্যরা পাহারা দিয়ে চুরির হাত থেকে সেগুলোকে রা করছে। এয়ারপোর্ট থেকে সেগুলোকে সাধারণত হেলিকপ্টারযোগে সামনের সরবরাহ-ডিপোতে নেয়া হচ্ছে এবং এরপর উপকূল ও বন্যায় ভেসে যাওয়া দ্বীপগুলোতে সেগুলোকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ব্রিটিশ কমান্ডো হেলিকপ্টারগুলো পটুয়াখালী সাপ্লাই কেন্দ্র থেকে প্রায় ৪,৫০০ টন চাল, তেল, ময়দা, বিস্কুট, চিনি, আলু, গুঁড়ো দুধ এবং কাপড়চোপড় নিয়ে উপদ্রুত অঞ্চলে নিয়ে যাচ্ছে। রেডক্রস ও অন্যান্য সংস্থার লোকজনকে সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে। কারণ, দুর্গতদের কাছে রিলিফ একটু দেরিতে হলেও ঠিকঠাকমতো পৌঁছে যাচ্ছে। রিলিফ বিতরণে এখন আর কোনো দেরি হচ্ছে না এবং রিলিফ সরবরাহেও কোনো ঘাটতি নেই।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার সরকারের ‘ভুল ও বিলম্ব’-এর কথা স্বীকার করেছেন এবং আন্তর্জাতিক সাড়াকে অভূতপূর্ব বর্ণনা করেছেন। তিনি অবশ্য বিদেশী সাহায্যের কতদিন পর্যন্ত প্রয়োজন রয়েছে সে-ব্যাপারে নিরব রয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে অন্তঃত এক বছরের জন্য সাহায্য প্রয়োজন হবে, কারণ সর্বগ্রাসী সমুদ্র ব-দ্বীপের কৃষিজ-ভূমিকে ধ্বংস করে ফেলেছে। পাকিস্তান বিশ্বব্যাংকের কাছে ৭৫ মিলিয়ন পাউন্ডের জরুরি উন্নয়ন প্রস্তাবনা পেশ করেছে। একটি কানাডীয় সংস্থা দ্রুত-জরিপের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারকে ঘূর্ণিঝড়-উপদ্রুত এলাকাকে “স্বাভাবিক” করে তোলার জন্য দু’বছরের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার পরামর্শ দিয়েছে। এটা নিশ্চিত যে আরো বেশি কিছু সময়ের প্রয়োজন হবে। একটি ব্যাপার হল, ৩০ মাইলব্যাপী উপদ্রুত-এলাকায় কোনো বাড়িঘরই দাঁড়িয়ে নেই। দ্বিতীয়ত, ধ্বংসপ্রাপ্ত জমিজমা পূর্বের উৎপাদন-ক্ষমতায় ফিরে যেতে তিন বছর সময় নেবে। ব্যাপক সেচকার্যের প্রয়োজন রয়েছে। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা পুনরায় চালু করতে হবে। এবং কৃষিজ ভূমিকে সমুদ্রের হাত থেকে রা করার জন্য নতুন বাঁধ নির্মাণের বিরাট দায়িত্ব সামনে রয়েছে। মাটি দিয়ে তৈরি ১৬ ফুট উঁচু পুরনো বাঁধ ভেসে গেছে। ডাচ-সরকার দ্রুত ও সহজে বাঁধ নির্মাণের পদ্ধতি বের করার জন্য একটি টিম পাঠাচ্ছে।
এই ধ্বংসযজ্ঞ একটি বড়ো রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে দাঁড়িয়েছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এটা অস্বীকার করা জরুরি হয়ে পড়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত ও ভারত দ্বারা বিভক্ত কেন্দ্রীয় সরকার পূর্বের ধ্বংসলীলা মোকাবেলায় উদাসীনতা ও অবহেলার পরিচয় দিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানীরা বলছে যে, বহির্বিশ্ব থেকে খাদ্য, হেলিকপ্টার ও অর্থ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসার আগেই এসেছে, এবং ৪.৪ মিলিয়ন পাউন্ড ত্রাণের জন্য বরাদ্দ ঘোষণা করতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ১০ দিন সময় লেগেছে। এছাড়া, প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠেছে যে, মৃতদের সৎকারের জন্য পাকিস্তানী সৈন্যদের পরিবর্তে ব্রিটিশ নাবিকদের ব্যবহার করা হয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ, যে-অংশ পাকিস্তানের ১১০ মিলিয়ন জনগণের মধ্যে পশ্চিমের তুলনায় দরিদ্রতম, এধরনের অভিযোগ এনে পশ্চিম পাকিস্তানের দলগুলোকে বিব্রত করার প্রচারাভিযানে নেমেছে। একটি সাংবিধানিক আইনপরিষদের জন্য পাকিস্তানে এখন থেকে আট দিনের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা। সর্ব-পাকিস্তানী আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা আশি ভাগ ভোট পাবার কথা।
তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে ঘূর্ণিঝড়-দুর্গতদের অবহেলা ও বঞ্চনার জন্য অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। শেখ একজন জাতীয়তাবাদী যিনি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণের জন্য স্বায়ত্তশাসন চান। কেন্দ্রীয় সরকারের এই ব্যর্থতা শেখকে অনেকখানি সাহায্য করতে এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করতে বাধ্য।
গতকাল প্রথমবারের মতো ঢাকায় এরকম পোস্টার দেখা গেছে যাতে বলা রয়েছে, ‘সব নির্বাচিত সদস্যকে অবশ্যই রাওয়ালাপিন্ডি (পশ্চিমের রাজধানী) থেকে নয়, ঢাকা থেকে শাসনকার্যের দাবি করতে হবে’। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মনে হয় এই বিরোধিতার মোকাবেলায় নামবেন। তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন যদি নবনির্বাচিত আইনপরিষদ এমন একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে যা তার ঠিক করে দেয়া মূলনীতর সঙ্গে না মেলে, তবে সামরিক শাসন চলতে থাকবে। মূলনীতিগুলোর একটি হলো পূর্ব পাকিস্তানের শুধু সীমিত স্বায়ত্তশাসন থাকা উচিত।
…
অনুবাদকের নোট: এই রিপোর্টে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে এতবড়ো একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় পশ্চিম পাকিস্তানী সরকার কতখানি অবহেলা প্রদর্শন করেছে, যেহেতু দুর্যোগটি পূর্ব পাকিস্তানে।
অনুবাদকের বাছাই: “পূর্ব পাকিস্তানীরা বলছে যে, বহির্বিশ্ব থেকে খাদ্য, হেলিকপ্টার ও অর্থ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসার আগেই এসেছে, এবং ৪.৪ মিলিয়ন পাউন্ড ত্রাণের জন্য বরাদ্দ ঘোষণা করতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ১০ দিন সময় লেগেছে। এছাড়া, প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠেছে যে, মৃতদের সৎকারের জন্য পাকিস্তানী সৈন্যদের পরিবর্তে ব্রিটিশ নাবিকদের ব্যবহার করা হয়েছে।”