দি টাইমস, ৬ মার্চ, ১৯৭১
পিটার হ্যাজেলহার্স্ট
অনুবাদ: ফাহমিদুল হক
করাচি। বিক্ষোভে উত্তাল পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে এখন দুটি বিকল্প আছে: তিনি এককভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন অথবা তিনি নিজেই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকতে পারেন এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সেখানে যোগ দিতে আহ্বান জানাতে পারেন। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জেড. এ. ভুট্টো নিশ্চিতভাবেই তাতে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানাবেন কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট প্রদেশগুলোর নেতারা শেখ মুজিবুরের সঙ্গে হাত মেলানোর জন্য প্রস্তুত থাকবেন।
পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশ দু-দশক ধরে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায় প্রাধান্য বিস্তার করে আসছে। কিন্তু বর্তমানে তারা বুঝতে পেরেছেন যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পাকিস্তানকে একত্রিত রাখতে চাইলে বাঙালির শাসনকেই মেনে নিতে হবে কারণ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কল্যাণে আইনসভায় তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ক্ষমতাসীনদের মধ্যে যেসব শান্তিকামী রয়েছেন, যারা মনে করেন যে ক্ষমতায় বাঙালিদের প্রাপ্য ভাগ দেয়া দরকার, তারা পরাস্ত হয়েছেন। আর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে তিনি হয়তো কট্টর পাঞ্জাবীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। অন্যদিকে সেনাবাহিনীর মধ্যে এই ভীতি কাজ করছে যে যদি বাঙালিরা ক্ষমতায় আসে তবে সামরিক বাহিনী কর্তন করে তার আকার ছোট করে ফেলা হবে।
সেনাবাহিনীর হাতে এক যুগ ধরে দমন-পীড়নের শিকার হবার কারণে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে যে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা হ্রাস করা হবে। তাই এটা পরিস্কার যে পাঞ্জাবীদের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী প্রেসিডেন্টকে প্রভাবিত করেছে সংবিধান রচনার পরিষদকে রদ করার জন্য। বোঝা যাচ্ছে এসপ্তাহের প্রথমার্ধে প্রেসিডেন্টকে বোঝানো হয়েছিল অধিবেশন প্রত্যাহার করে নিলে বাঙালিরা সামরিক শৌর্য্যরে কাছে নতজানু হবে। পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় গভর্নর ভাইস এডমিরাল এস এম আহসান পরে পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টকে অধিবেশন স্থগিত করার বিপরীতে তার পরামর্শ দেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার মন্ত্রিসভার কট্টরপন্থীদের পরামর্শেই কাজ করেন। বাংলায় পরিস্থিতির অধিক অবনতি এডমিরাল আহসানের অবস্থানকেই সত্য প্রমাণ করেছে এবং প্রেসিডেন্টকে এখন পেছনে ফিরে আসতে হবে এবং অধিবেশনের একটি নতুন তারিখ ঘোষণা করতে হবে।
ইয়াহিয়া খানের প্রশাসনের সামরিক পর্যবেক্ষকরাই স্বীকার করেছেন যে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ঠেকিয়ে রাখা খুব কঠিন হবে এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া পূর্ব পাকিস্তানের ৭৫ মিলিয়ন মানুষকে বলপূর্বক দমিয়ে রাখা যাবে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক কিছু নির্ভর করছে মি. ভুট্টো কী করার সিদ্ধান্ত নেন তার ওপর। যদি ইয়াহিয়া নতুন অধিবেশনের তারিখ ঘোষণা করেন এবং তাতে ভুট্টো যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান তবে পাকিস্তানে গুরুতর আঞ্চলিক সমস্যার সৃষ্টি হবে। এই সংঘাত হবে পাঞ্জাব প্রদেশের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট ছোট প্রদেশ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান ও সিন্ধুর মিলিত জোটের যারা পাঞ্জাবের সম্মতি ছাড়াই সংবিধান প্রণয়ন করতে পারবেন।
কিন্তু চূড়ান্ত বিশ্লেষণে এটা বের করা কঠিন যে শেখ মুজিবুর রহমান এবং মি. ভুট্টো আইনসভায় তাদের পার্থক্য কীভাবে ঘোচাবেন এবং উভয় পাকিস্তানে গৃহীত একটি সংবিধান কীভাবে প্রণয়ন করবেন। বিশ্বে অর্জিত ইতিবাচক যা ভাবমূর্তি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আছে তাকে সঙ্গী করেও ইয়াহিয়ার পে এরকম কোনো সংবিধান অনুমোদন করা সম্ভব নয় যা ভুট্টোর কাছে, পাঞ্জাবের কাছে ও সেনাবাহিনীর কাছে অগ্রহণযোগ্য। বাঙালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারভিত্তিক কোনো সংবিধান অনুমোদন করতে প্রেসিডেন্ট যদি ব্যর্থ হন তবে তবে শেখের পক্ষে ঘোষণা দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না যে পশ্চিমাংশ পুরো পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং প্রদেশ দু-টি চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।