দি গার্ডিয়ান, ১২ মার্চ, ১৯৭১
মার্টিন এডনে
ঢাকা, মার্চ ১১। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি চরম সংকটের মুখে পড়েছে। কারণ আওয়ামী লীগের শেখ মুজিবুর রহমানই এখন প্রদেশটির সরকারের মতো কাজ চালাচ্ছেন এবং তার নির্দেশ মতো স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বন্ধ রয়েছে। যদিও অর্থ উত্তোলনের ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধ আছে — ব্যবসায়ীরা এক মাসে ১,০০০ টাকা ও চাকুরীজীবিরা ১,৫০০ টাকার বেশি তুলতে পারবে না — কিন্তু ব্যাংকগুলো এই চাহিদাটুকুও পূরণ করতে পারছে না, এমনকি তারা একে অপরের চেককেও বিশ্বাস করছে না। পাটকলগুলো আগামী রোববারে পাট কিনতে ও মাসিক বেতন-প্রদান করতে পারেব কিনা তা নিয়েও তারা চিন্তিত। আওয়ামী লীগ গর্ব করে বলছে রফতানি বন্ধ আছে কারণ জাহাজের মালিকরা শুল্ক ধর্মঘটে যোগ দেয় নি।
রোববারে মুজিবের বক্তৃতার পর যে অনুপ্রেরণা কাজ করছিল, প্রেসিডেন্টের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হয় তা দেখতে যে-উদ্বিগ্ন প্রতীক্ষা শুরু হয়েছে তা অনুপ্রেরণাকে দূর করে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট পূর্ব পাকিস্তানে কবে আসবেন তা অনিশ্চিত, কিন্তু গুজব শোনা যাচ্ছে যে তিনি আজ রাতেই আসছেন।
দ্রব্যমূল্যের দামের ঊর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছে — চালের দাম বেড়েছে শতকরা ২০ ভাগ এবং রান্নার তেলের দাম বেড়েছে শতকরা ৫০ ভাগ। অনেক লোকই ঢাকা ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে গিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। এরকম একটি কথাও অনেকে ভাবছেন যে বর্তমানের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতে পারে না। কেউ কেউ বলছেন এসব করে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থই পূরণ করা হচ্ছে। কেবল ব্যবসায়ীরা নয়, অনেক লোকই এখন ভাবছে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হওয়া খুব বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে কিনা। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত পাঁচ লক্ষ বাঙালির সঙ্গে কোনো প্রকার যোগাযোগ নেই।
এরকম কোনো ধারণা দেয়া মুশকিল যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এই প্রদেশটি নিজেকে কতটা স্বাধীন ভাবে যার সঙ্গে কোনো ধরনের ডাক, টেলিফোন বা টেলিগ্রামে যোগাযোগ নেই। একটা রিকশায় করে আমি একটি পানির গাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। গাড়িটির পেছনে ছয় জন লোক ঝুলছিল। তারা বলে উঠলো: “জয় বাংলা”। আমার রিকশাচালক মাথা ঘুরিয়ে বললো: “স্বাধীন বাংলা”। আমি জিজ্ঞেস করলাম এই দু-টি চিৎকারের মধ্যে পার্থক্য কী? রিকশাওয়ালাটা বললো, “কোনো পার্থক্য নেই”।
এখানকার সব বিচারপতি একটি নতুন গভর্নরের অধীনে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এ-হলো বাঙালি ঐক্যের আরেক সাক্ষ্য যার মধ্যে ব্যবসায়ী গর্ব এবং হাওয়ার কাছে সমর্পণের বিচক্ষণতা। এই চেতনার স্রোত সৃষ্টি হয়েছে মুজিবের আহ্বান থেকে। আবার মুজিবেরও কোনো উপায় নেই, তাই তাকে এই চেতনা বহন করতে হচ্ছে। এটা মনে হচ্ছে যে ইয়াহিয়া আসছেন শেখকে কিছু ছাড় দিতে, কিন্তু কোন পর্যন্ত তিনি তা দিতে পারেন তার নানা দিক রয়েছে। এটা পরিস্কার যে মুজিব যদি তার অনুসারীদের সঙ্গে রাখতে চান তবে তাকে অন্তঃত আওয়ামী লীগের ছয় দফা অনুসারে দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে এবং রাজস্ব ও বৈদেশিক বাণিজ্য হাতে রাখতে হবে।
কিন্তু এটা খুবই সন্দেহজনক সেনাবাহিনী এটা মেনে নিবে কিনা। কারণ জাতীয় বাজেটের অর্ধেকেরও বেশি তারা প্রতি বছর নিয়ে থাকে। শেখের সমর্থকরা এটা দাবি করছেন যে ইয়াহিয়া প্রদেশের মতা আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিবের কাছে হস্তান্তর করবেন, কিন্তু এটা একটা আশাবাদী ধারণা মাত্র। এটা জানা কঠিন যে মুজিব কী ধরনের স্বায়ত্তশাসন রফা করবেন, যিনি এখন পর্যন্ত বিশ্বাস করেন স্বাধীনতার সামান্য কম স্বায়ত্তশাসন পেলে থেমে যাওয়া যায়। হয়তো দুই প্রধানমন্ত্রির কনফেডারেশনকে তিনি মেনে নেবেন। ইতোমধ্যে সেনাবাহিনী ঢাকা বিমানবন্দরের কাছাকাছি অপেক্ষা করছে। তারা বিশ্বাস করে আদেশ দেয়া হলে তারা দ্রুতই প্রদেশটিকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে, যদিও বাঙালিরা দূরবর্তী যোগাযোগ-ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটিয়ে চলেছে। অবশ্য তারা এটাও জানে যে এই সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক ফলাফল কত ভয়াবহ হতে পারে।
এখানে দুই ডিভিশন সৈন্য আছে বলে জানা যায় যাদের মধ্যে কিছু আছে বাঙালি। এছাড়া আছে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস্, যারা স্থায়ী সীমান্তরাকারী বাহিনী। তাদের সংখ্যা ২০,০০০-এর কিছু বেশি যারা সেনা ঘাঁটি থেকে দূরে এখানে রয়েছে এবং তাদের হাতে রাইফেলের চাইতে সামান্য শক্তিশালী অস্ত্র রয়েছে। অভিযান শুরু হলে তাদের আনুগত্য বিভক্ত হয়ে পড়তে পারে। আবার এরকম গুজবও শোনা যাচ্ছে বিমানযোগে আরও সৈন্য আসছে এবং নৌজাহাজে আরও সৈন্য রওয়ানা দিয়েছে। সেনাবাহিনীর ওপর কঠোর নির্দেশ আছে যাতে কোনো ধরনের ঘটনাকে তারা উস্কে না দেয় গত রাতে এখান থেকে উত্তরে কিছু সরবরাহের জন্য যাওয়া চারটি গাড়ির একটি কনভয় জনতার বাধার মুখে পড়লে গুলিবর্ষণ ছাড়াই তার ফিরে যায়। কিন্তু সাধারণভাবে সেনাবাহিনী সাধারণ ঠিকাদারদের মাধ্যমেই বিভিন্ন সরবরাহ পাচ্ছে যদিও চরমপন্থী নেতারা তা প্রতিরোধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এখানে আরও একটি কথা হচ্ছে যে, প্রেসিডেন্ট যদি কঠোর পদক্ষেপ নেন তবে তার ফল কী হবে। এর অর্থ পাল্টা উদ্যোগ মুজিবের দিক থেকে না এসে অন্য দিক থেকেও আসতে পারে। কট্টরপন্থীদের কাছে মুজিব কোনো বিপ্লবী নন এবং তার রাজনৈতিক দর্শনও যথেষ্ট অস্পষ্ট। কিছু তথাকথিত গেরিলা-গোষ্ঠী আছে যারা গত কয়েক মাসে গ্রামাঞ্চলে কিছু রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যা করেছে এবং এরকম একটি ভয় আছে যে পশ্চিমবঙ্গের মতো এখানেও নকশাল আন্দোলন ছড়িয়ে যেতে পারে — বিশেষত মুজিবকে যদি দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। বাঙালিদের সাহসিকতার কথা শোনা গেলেও বৃহদাকারে সংগঠিত কোনো প্রতিরোধের পরিকল্পনার নিদর্শন দেখা যায় নি।
গত কয়েক সপ্তাহ জুড়ে যে প্রবল বাঙালি জাতীয়তাবাদ দেখা দিয়েছে যদিও তার ভবিষ্যত ঘোলাটে বলেই মনে হচ্ছে। যদি এই জাতীয়তাবাদ নিজেকে পরিচালিত করতে পারে তবে এই পশ্চাদপদ ও হতাশ প্রদেশটির জন্য তা মূল্যবান সম্পদই হবে। অবশ্য তারা সবসময়ই বলার জন্য প্রস্তুত থাকে যে তাদের এই পশ্চাদপদতার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান দায়ী। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা সম্ভবত আট কোটি এবং আশংকা করা হচ্ছে কার্যকর জন্মনিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা চালু করা না গেলে এই সংখ্যা আগামী ২৩ বছরে দ্বিগুণ হবে। নতুন কোনো ভূমি নেই চাষ করার জন্য। এমনকি গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের মাঝামাঝি অঞ্চলের কর্দমাক্ত ভূমিতেও ধানচাষ করা হয় এবং শহর দ্রুত সেদিকে ধাবিত হচ্ছে। একমাত্র আশা হলো ইতোমধ্যে উন্নত বীজ উদ্ভাবিত হয়েছে, অধিক সার ব্যবহার করা হয়েছে ও অধিক সারের অর্ডার দেয়া হয়েছে এবং সেচব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।
এখানকার প্রধান রফতানি-পণ্য হলো পাট এবং সিন্থেটিক ফাইবারের আবির্ভাবে তা হুমকির মুখে পড়েছে। ব্যাপক প্রনোদনা সত্ত্বেও শিল্প বিঘ্নিত হয়েছে ও বিনিয়োগ বিফলে গেছে। কেউ নিন্দুকের মতো বলতেই পারেন পূর্বকে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে পশ্চিম খুব কৃপণ হতে পারে, কিন্তু পৃথিবীর সবচাইতে জনবহুল এই জনগোষ্ঠীর দুর্দশার খানিক উন্নতি ঘটাতে চাইলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পুরো সঞ্চয় ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন হবে।