দি গার্ডিয়ান, ১৬ নভেম্বর, ১৯৭০
কলিম সিদ্দিকী
অনুবাদ: ফাহমিদুল হক
বঙ্গোপসাগরের দিকে ধাবমান নদী গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র সৃষ্ট ব-দ্বীপে ছোট ছোট দ্বীপ ও অসংখ্য খালবিল নিয়ে কলকাতার পূর্ব দিকে দেশটি অবস্থিত। এই নদীমাতৃক দৃশ্যপটে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ তিনটি জিনিস নিয়ে বেঁচে থাকে — বন্যা, খাদ্য ও দুর্ভিক্ষ — তিনটিই সমানভাবে বিখ্যাত। দেশটির বেশিরভাগ অংশ সমতল ও নিচু যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১.৫ থেকে ২.০ ফুট উঁচু।
সমুদ্র সাধারণত গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র থেকে জল গ্রহণ করে। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ সে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, বদ্বীপের উপরিতলটি ভাসিয়ে নেয়। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা হয় ২০ ফুটের মতো, কখনো কখনো এমনকি ৫০ ফুটের মতো। একেকটি জলোচ্ছ্বাস এসে, বিগত জলোচ্ছ্বাসের পর মানুষ যা বিনির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিল, তার সবকিছু ধ্বংস করে ফেলে।
প্রকাশিত
বদ্বীপ অংশটি পূর্ব পাকিস্তানের ৭০ মিলিয়ন লোকের শতকরা ৮০ ভাগ ধারণ করে যেটি হল বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল — প্রতি বর্গমাইলে এখানে ১২০০ লোক বাস করে। বঙ্গোপসাগরের দয়ায় মাত্র তিন থেকে পাঁচ মিলিয়ন লোক এর করাল থাবায় সরাসরি আক্রান্ত হয়। কিন্তু এই জনগোষ্ঠী পৃথিবীর সবচাইতে দরিদ্রদের একটি যেখানে মাথাপিছু আয় মাত্র ২০০ রুপি। (পাকিস্তানের গড় মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ৪১৮ রুপি বা প্রায় ৩০ পাউন্ড যদি সেখানে তুলনামূলকভাবে ধনী পশ্চিম পাকিস্তানকে যোগ করা হয়।)
উদ্ধারকারীরা এবং সরকার সাধারণত এত দেরিতে উপদ্রুত অঞ্চলে পৌঁছে যে জনগণের জন্য তাদের আর তেমন কিছু করার থাকে না। তারা উপদ্রুত এলাকার সমস্যাগুলোকে সমাধান-অযোগ্য মনে করেন, পূর্বের অভিজ্ঞতা মনে করে কাঁধ ঝাঁকান এবং ঢাকা বা ইসলামাবাদে ফিরে যান। আরেকটা জলোচ্ছ্বাস না আসা পর্যন্ত তাদের আর দেখা পাওয়া যায় না। এরপর ফ্যাশন্যাবল একটি সংবাদ শোনা যায় — ‘সাইক্লোনের কারণে সব যোগাযোগ-ব্যবস্থা বিঘ্নিত।’ তারা বড়োজোর এরকম কিছু করতে পারেন যে, হেলিকপ্টার ও বিমানে করে তারা উড়তে থাকবেন, নিচের ধ্বংসলীলা দেখবেন এবং সম্ভবত যেখানে জনমানুষের অস্তিত্ব দেখতে পাবেন সেখানে খাদ্য ফেলবেন। সত্যি কথা হল, এ-অঞ্চলে আধুনিক কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থাই নেই যা বিঘ্নিত হতে পারে। সবচেয়ে ভালো অবস্থায় এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যেতে পরের নৌকাটি পেতে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়।
কর্তৃত্ব
ভূগোল অবশ্য এলাকাটির একমাত্র সমস্যা নয়। ইতিহাস জুড়ে বাংলা হল ভারতীয় মূল ভূখণ্ডে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের সীমান্তভূমি। বাংলা সবসময় দূরবর্তী শাসনকর্তা দ্বারা শাসিত হয়েছে, এবং মজার ব্যাপার হল ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পরে শাসনকর্তারা ইতিহাসের সবচেয়ে দূরবর্তী শাসনকর্তায় পরিগণিত হন।
কিছু পরস্পরবিরোধিতা পরীক্ষা করা যাক। ব্রিটিশরা পাটশিল্প প্রবর্তন করেছিল, কিন্তু দেশবিভাগের কারণে সে মিলগুলো কলকাতায় থেকে গেল। পূর্ব পাকিস্তানে অনেক নতুন জুটমিল স্থাপন করা হয়, কিন্তু সরকার প্রবর্তিত কৃষিজ-পণ্যের মূল্য-নির্ধারণী-নীতি ঢাকা ও চট্টগ্রামের উদ্যোক্তাদের হাতে চাষীদের শোষিত হবার প্রক্রিয়াটি বন্ধ করার ব্যাপারে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। পশ্চিম পাকিস্তানের অপেক্ষাকৃত উন্নত নগর অঞ্চলের শিল্পায়ন উন্নয়নের কাজ হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের পাটনির্ভর অর্থনীতির উদ্বৃত্ত ব্যবহার করে। পূর্ব থেকে পশ্চিমে সম্পদ স্থানান্তরের বার্ষিক পরিমাণ ২৫০ মিলিয়ন রুপি। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে, বিশেষত ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক স্বৈরাচার চালু হবার পর থেকে এ-অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান ক্ষতির পরিমাণ বিশাল।
এই সম্পদের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানে বন্যা-নিয়ন্ত্রণের খরচে কম বরাদ্দ হয়। কয়েক বছর থেকে এ-সমস্যা নিয়ে গবেষণারত বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে ২০টি বহুমুখী প্রকল্প এই সমস্যার বৃহত্তর সমাধান দিতে পারে যার আনুমানিক খরচ হবে ৮০০ মিলিয়ন ডলার।
অর্জন
বিদেশী গাড়ি (প্রধানত জাপানি এবং জার্মানি), রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডশনার, এবং অন্যান্য ভোগ্যপণ্য আমদানি করতে পাকিস্তান যা খরচ করে, তার তুলনায় এই খরচ একটি নতুন পরিপ্রেক্ষিতের জন্ম দেয়। পাকিস্তান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রায় ২০% সুদে ব্যয় করে ৫ বিলিয়ন ডলারের অধিক বিদেশী ঋণের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। যেকোনোভাবেই কোনো দৃঢ়চেতা সরকার অভ্যন্তরীণ মুদ্রা-সম্পদের সমস্যায় পড়তে পারে না। এসব কারণে বিশ্বব্যাংক প্রস্তাবিত বাঁধ বা খাল নির্মাণকর্ম নাও করা যেতে পারে, যদিও কোনো বৈদেশিক সাহায্য ছাড়াই একটি বাঁধ-ব্যবস্থা বিপর্যয়ের মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে। এটা ইচ্ছার ব্যর্থতা, অর্থের নয়। কিন্তু বিশ্বব্যাংক প্রয়োজনীয় ৮০০ মিলিয়ন ডলার দেবে না; কারণ মৃত্যু ও ধ্বংসের এই মাত্রা একটি রাজনৈতিক ইস্যু নয়। সিন্ধুর পানি নিয়ে ভারত-পাকিস্তান বৈরিতা নিয়ে বিশ্বব্যাংক এবং পশ্চিমা শক্তিগুলো অবশ্য ‘শান্তিরক্ষায় এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ’ করেছিল।
তবে এখন কিছু নিদর্শন দেখা যাচ্ছে, যাতে বোঝা যাচ্ছে যে, বর্তমান সরকার সমস্যাগুলোকে একটু গুরুত্বসহকারে দেখছে। প্রত্যেক বক্তৃতায় জেনারেল ইয়াহিয়া খান বন্যা-নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি একমাত্র যে পদেক্ষেপের কথা ঘোষণা করেছেন তা হলো: ‘আমার নির্দেশনা অনুযায়ী পরিকল্পনা কমিশন এই কর্মসূচীতে আর্থিকভাবে সাহায্য করার জন্য বন্ধুভাবাপন্ন সব দেশ থেকে সহায়তা সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে। আমি নিশ্চিত যে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যতের জন্য জরুরি এই সমস্যা সমাধানের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিবে।’
আমন্ত্রণ
কিন্তু প্রেসিডেন্ট সমস্যার ভয়াবহতাকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে ভাবেননি। সমস্যা সমাধানে অভ্যন্তরীণ সম্পদের ব্যবহার এবং অন্তঃত বিষয়টিকে কম ধ্বংসাত্মক হবার ব্যবস্থা করা সরকারের এজেন্ডার মধ্যে আসেনি। ইয়াহিয়া খান বলেন: ‘এই উপলক্ষে আমাদের বিশেষ একটি তহবিল গঠনের ইচ্ছা আছে, বন্ধুভাবাপন্ন দেশসমূহকে এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাসমূহকে সাহায্য প্রদান করার আহ্বান জানানো হবে এবং যাতে পাকিস্তান নিজেই যথেষ্ট পরিমাণে অর্থ প্রদান করবে।’
বিশ্বসংস্থা ও দেশসমূহ ইয়াহিয়া খানের আবেদনে সাড়া দিবে কি না তা এখন দেখার বিষয়। কিন্তু পাকিস্তানের জন্য তার চাইতে বড় আকাঙ্ক্ষার বিষয়, বেসামরিক ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া — এ-মুহূর্তে সমুদ্রের জলে ভেসে গেছে।