Author Archives: Webmaster

রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাওলানা ইউসুফ – হত্যা নির্যাতনের অসংখ্য অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে

রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাওলানা ইউসুফ – হত্যা নির্যাতনের অসংখ্য অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে

আজাদুর রহমান চন্দন/প্রতীক ইজাজ

জামায়াতে ইসলামীর নতুন ভারপ্রাপ্ত আমির মাওলানা আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফ একজন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী। একাত্তরে তিনিই প্রথম খুলনায় প্রতিষ্ঠা করেন রাজাকার বাহিনী। শান্তি কমিটিরও তিনি ছিলেন খুলনা জেলার আহ্বায়ক। তারই নেতৃত্বে পরিচালিত হতো সেখানকার নয়টি প্রধান নির্যাতন সেল। রাজাকার বাহিনীর ৯৬ ক্যাডার মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাস সেসব সেলে পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পরে মানুষদের ওপর। সেখান থেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হতো শহরের প্রধান চারটি স্থানে।

মাওলানা একেএম ইউসুফ খুলনায় রাজাকার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে নেতৃত্বে দেওয়ার পাশাপাশি দেশ-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার দায়িত্বও পালন করেন। ডা. মালেক মন্ত্রীসভার সদস্য হিসেবে তিনি পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে গণহত্যা ও যুদ্ধপরাধে সক্রিয় সহযোগিতা দেন। ওই কুখ্যাত মন্ত্রীসভায় তিনি ছিলেন রাজ মন্ত্রী।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আইনের অধীনে যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয় ইউসুফের। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দালালি করার অভিযোগে ’৭২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে মালেক মন্ত্রীসভার সদস্য ও রাজনৈতিক নেতাসহ ৩৭ হাজার ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। আদালতের রায়ে অন্য অনেকের সঙ্গে যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয় একেএম ইউসুফের। কিন্তু পরে সরকারের সাধারণ মা ঘোষণার আওতায় সে বছরের ৫ ডিসেম্বর মুক্তি পান মাওলানা ইউসুফ।

গ্যাটকো দুর্নীতির মামলায় গত রোববার জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী গ্রেফতার হওয়ার পরদিন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মাওলানা আবুল কালাম ইউসুফকে দলের ভারপ্রাপ্ত আমির নির্বাচিত করা হয়। কুয়েত থেকে দেশে ফিরে বুধবার তিনি দায়িত্ব নিয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বসেন। তার বাড়ি বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার রাজৈর গ্রামে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় খুলনা জামায়াতের নেতা ছিলেন তিনি। খুলনা জেলা শান্তি কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে ওই সময় তার নাম ছাপা হয় পাকিস্তান অবজারভারসহ বিভিন্ন পত্রিকায়।

ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির তৈরি ‘গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে প্রত্য অথবা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের তালিকা’য় একেএম ইউসুফের নাম উঠে এসেছে। ১৯৭২ সালে দালাল আইনে গ্রেফতার হওয়া মালেক মন্ত্রীসভার অপর এক সদস্য দালালির অভিযোগে মাওলানা ইউসুফের জেল খাটার সত্যতা স্বীকার করেছেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীবিরোধী গণআন্দোলনের সময় কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের ’৯৪ সালের ২৬ মার্চ প্রকাশিত দ্বিতীয় দফার তদন্ত প্রতিবেদনে ৮ যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে মাওলানা ইউসুফের নাম পাওয়া গেছে।

মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দলিলপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, একাত্তরের মে মাসে মাওলানা ইউসুফই দেশে প্রথম জামায়াতের ৯৬ জন ক্যাডার নিয়ে খুলনায় রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। খুলনার তৎকালীন ভূতের বাড়ি (বর্তমানে আনসার ক্যাম্পের হেড কোয়ার্টার) ছিল তার রাজাকার বাহিনীর হেড কোয়ার্টার এবং প্রধান নির্যাতন সেল। দুটি প্রধান নির্যাতন সেল ও রাজাকার বাহিনীর ক্যাম্প ছিল বর্তমান শিপইয়ার্ড ও খালিশপুরে। এছাড়া পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর মহৃল ক্যাম্প সার্কিট হাউস এবং পাকিস্তানি বাহিনীর অপর চারটি ঘাঁটি হেলিপোর্ট, নেভাল বেস, হোটেল শাহিন ও আসিয়ানা হোটেলও হয়ে উঠেছিল এই বাহিনীর নির্যাতন সেল। প্রথম তিনটি নির্যাতন সেল পরিচালিত হতো সরাসরি রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্বে আর পাকিস্তানি বাহিনীর অবশিষ্ট চারটি ঘাঁটি যৌথভাবে পরিচালিত হতো। তবে অধিকাংশ হত্যাকান্ডই সংঘটিত হয়েছে গঙামারি, সার্কিট হাউসের পেছনে ফরেষ্ট ঘাঁটি, আসিয়ানা হোটেলের সামনে ও স্টেশন রোডসহ কিছু নির্দিস্ট স্থানে।

কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে গঠিত গণআদালতের কাছে প্রত্যদর্শীরা একাত্তরে খুলনায় মাওলানা ইউসুফের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীর নানা যুদ্ধাপরাধের বিবরণ তুলে ধরেন। এদেরই একজন শহীদ আবদুর রাজ্জাকের মা গুলজান বিবি কমিশনকে জানান, একাত্তরের আষাঢ় মাসের একদিন রাজাকার খালেক মেম্বার তার ছেলে রাজ্জাককে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে বলে। রাজ্জাক তা প্রত্যাখ্যান করলে সে মাসের ১১ তারিখ সকালে খালেক মেম্বার ও অপর রাজাকার আদম আলী পুনরায় বাসায় এসে রাজ্জাককে ধরে নিয়ে যায়। সেদিন সন্ধ্যায় গুলজান বিবি জানতে পারেন তার ছেলেকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ছেলেকে ছাড়িয়ে আনার জন্য মা গুলজান বিবি রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা একেএম ইউসুফের কাছে যান এবং তার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে করজোড়ে অনুরোধ জানান। সে সময় মাওলানা ইউসুফের সঙ্গে খালেক মেম্বারও ছিল। তারা দু’জনই জানিয়ে দেন, রাজ্জাককে ছাড়ানোর ব্যাপারে কোনো অনুরোধেও কাজ হবে না। পরে গুলজান বিবি তার ছেলেকে আর পাননি। সন্ধান পাননি লাশেরও।

কমিশনের কাছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রত্যদর্শীরা আরো জানান, মাওলানা ইউসুফের কথামতো খালেক মেম্বার ও আদম আলীর মতো আরো কয়েকজন রাজাকার সে সময় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পরে আরো অসংখ্য নারী-পুরুষকে হত্যা করেছে এবং নারী ধর্ষণ করেছে। রাজাকার বাহিনী গঠনের পর মাওলানা ইউসুফ মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা থেকে বহু লোককে জোর করে ধরে নিয়ে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করেছিলেন। যারা রাজি হননি, তাদের মেরে ফেলা হয়েছে। অনেকের লাশও পাওয়া যায়নি। এসব প্রত্যদর্শী প্রাণভয়ে তাদের নাম প্রকাশে অনীহা জানান।

মাওলানা ইউসুফের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকান্ডের অসংখ্য দলিল ও প্রমাণপত্র ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির কাছে রয়েছে বলে কমিটির আহ্বায়ক ডা. এমএ হাসান সমকালকে জানান। তিনি বলেন, ‘মাওলানা ইউসুফের যুদ্ধাপরাধের দালিলিক প্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে। সে সময় তিনি জামায়াতের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। মন্ত্রিসভায় জামায়াতের যে গুরুত্বপূর্ণ দুই সদস্যকে অন্তর্ভু্ক্ত করা হয়, তাদের মধ্যে মাওলানা ইউসুফ ছিলেন একজন। এখনো তিনি জামায়াতের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি প্রায়ই কুয়েত, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পড়ে থাকেন। কারণ দেশে দলসহ জঙ্গি কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য মুসলিম দেশগুলো থেকে মহৃলত তিনিই অর্থ সংগ্রহ করে থাকেন।’

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দালাল আইনের অধীনে মাওলানা ইউসুফের দন্ডাদেশ এবং জেলখাটার সত্যতা স্বীকার করেছেন মালেক মন্ত্রীসভার অপর এক সদস্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সদস্য জানান, ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে তাকে ও মাওলানা ইউসুফসহ মন্ত্রীসভার সবাইকে ’৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। দালাল আইনের অধীনে আদালত তাকেসহ অন্য অনেকের সঙ্গে মাওলানা ইউসুফকেও যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন। মাওলানা ইউসুফ হাইকোর্টে আপিলও করেছিলেন। কিন্তু তার রায় বেরুনোর আগেই তৎকালীন সরকারের সাধারণ মা ঘোষণার আওতায় তারা সবাই মুক্তি পেয়ে যান। কিন্তু মাওলানা ইউসুফ কি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় পড়েন এ প্রশ্নের উত্তরে মালেক মন্ত্রীসভার ওই সদস্য আরো বলেন, তখন তার বিরুদ্বে এতসব প্রমাণপত্র উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি বলেই তিনি মুক্তি পান।

এসব বিষয়ে মতামত জানার জন্য গতকাল শুত্রক্রবার জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার মোবাইল ফোনে বারবার চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি।

’৭১ সালের ১০ অক্টোবর খুলনার জনসভায়, ২৬ অক্টোবর সিলেটের জনসভায়, ১২ নভেম্বর সাতক্ষীরার রাজাকার শিবির পরিদর্শনকালে এবং ২৮ নভেম্বর করাচিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালেসহ বিভিন্ন সময় তার বক্তৃতা-বিবৃতিতে স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থানের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এসব বক্তৃতা-বিবৃতি পরেরদিন দৈনিক বাংলার বাণী, দৈনিক সংগ্রামসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

কীসের জন্য তারা পালিয়ে গেল?

দি ইকোনমিস্ট, ১২ জুন, ১৯৭১

কলকাতা থেকে আমাদের বিশেষ প্রতিনিধির পাঠানো রিপোর্ট

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

‘আমাদের জনসংযোগের যন্ত্র প্রস্তুত ছিল না। আমাদের সেনাবাহিনীর জনসংযোগ-কর্মকর্তারা ২৫ ও ২৬ মার্চে ঢাকায় ছিলেন না, এবং আমরা অবশ্যই সেখানে বিদেশী প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটা ভুল করেছিলাম।’ একজন সিনিয়র পশ্চিম পাকিস্তানি কূটনীতিক এভাবে স্বীকার করলেন যে পূর্ব পাকিস্তানকে তার সরকার যেভাবে মোকাবেলা করেছে তা পুরোপুরি সঠিক ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে কী এমন ঘটেছে যে পৃথিবীর সবচাইতে জনবহুল এবং দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর ৫০ লক্ষ মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে উদ্বাস্তুতে পরিণত হলো?

শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যরা ২৫ মার্চের রাতে অভিযান চালিয়ে গুলিবর্ষণ করে ও ঢাকার একাংশ ধ্বংস করে ফেলে এবং পরের ছয় মাসে পূর্ব পাকিস্তানের বেশিরভাগ অংশে নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে। এর ফলে লাখ লাখ উদ্বাস্তু সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্যগুলোতে পালিয়ে যায়। সেনাবাহিনীর মতে মার্চে আওয়ামী লীগের চরমপন্থীরা একটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছিল এবং এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত হাজার হাজার পশ্চিম পাকিস্তানী ও বিহারীরা ( এরা পশ্চিম-পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে সবসময় ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত) বাঙালিদের দ্বারা নিগৃহীত হতো। আর সেনাবাহিনীর সেদিনের দ্রুত পদক্ষেপ সবকিছু রক্ষা করে।

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সদস্য এবং পুলিশ ও আধা সামরিক সীমান্তরক্ষীরা সেদিন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। আওয়ামী লীগের নেতারা, যারা ভারতে পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন, তারা স্বীকার করেছেন বেশ কিছু পাঞ্জাবী ও বিহারী নিহত হয়েছিল। কিন্তু এটা কোনো পরিকল্পিত ঘটনা ছিল না। কী ঘটতে যাচ্ছে তা বোঝার আগেই অনেক সৈন্য ও পুলিশকে ধরা হয়েছিল, অস্ত্র কেড়ে নেয়া হয়েছিল, হত্যা করা হয়েছিল। শেখ মুজিবকে তার বাসভবন থেকে ধরা হয়েছিল এবং তারা দলের নেতাদের কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, কেউ অল্পের জন্য পালিয়ে বেঁচেছিলেন। সহিংসতা দুই দিক থেকেই হয়েছিল, এবিষয়ে অল্প হলেও সন্দেহ আছে। কিন্তু মুসলিম ও হিন্দু (এবং খ্রিস্টান), শিক্ষিত ও অশিক্ষিত উদ্বাস্তুর ঢল দেখে বোঝা যায়, জনগোষ্ঠীর প্রধান কেন্দ্রগুলোত নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের জন্য যা করা প্রয়োজন, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তার চাইতে বেশি কিছু করেছে।

সেনাবাহিনী কী করেছে? প্রতিটি অভিযানের পর দেখা গেছে গ্রামগুলো পুড়ে ছাই হয়েছে এবং মানুষগুলো মরেছে। একটি ব্যাখ্যা এরকম আছে যে, মাত্র ৭০,০০০ সৈন্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী সরকার পুরো পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ন্ত্রণ রাখতে চাইলে এধরনের সহিংসতার পথই নিতে হবে। কিন্তু সত্যি কথা হলো ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সমাধানের জন্য এধরনের নীতি ক্ষতিকর। কারণ রাজনৈতিক সমাধান অস্ত্রের শক্তির ওপর নির্ভর করে না, এখানে মানুষের গণহারে দেশত্যাগের ব্যাপারও রয়েছে। কিছু শিক্ষিত উদ্বাস্তু ব্যাখ্যা দিলেন, ‘সৈন্যদের গুলি করতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য অফিসাররা তাদের বলে যে এটা একটা ধর্মযুদ্ধ। তারা বলেছে যে ইসলামী রাষ্ট্রটি হিন্দু, আওয়ামী লীগ নেতা ও বুদ্ধিজীবিদের কারণে হুমকির সম্মুখিন।’

মৃত, ধৃত অথবা পলাতক বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবী ও আওয়ামী নেতাদের হিন্দু দেখতে পেলে সেনাবাহিনী খুশি হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে ৭ কোটি জনগোষ্ঠীর এক কোটি হিন্দু এবং এরা গণহারে সীমান্ত অতিক্রম করে গেছে। কিন্তু কেবল সেনাবাহিনীই হিন্দুদের তাড়িয়ে দিয়েছে তা নয়। বিহারী ও ডানপন্থী মুসলিম লীগারদের নিয়ে সম্প্রতি গ্রামে গ্রামে গঠিত তথাকথিত শান্তিকমিটির সদস্যরাও হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করে নিয়েছে, লুট করেছে এবং তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে।

সীমান্তাঞ্চলে যে যে স্থানে সেনাবাহিনীর শক্তি বেশি এবং যে যে স্থানে সেনাবাহিনী তাদের অভিযান চালিয়েছে সেখানকার লোকজনের সীমান্ত অতিক্রম করে পালিয়ে যাবার হার বেশি। প্রথমে এই পালিয়ে যাবার হার ছিল মোটামুটিভাবে অর্ধেক মুসলমান, অর্ধেক হিন্দু। কিন্তু মে মাসের প্রথম দিকে যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে যায়, হিন্দুদের পালিয়ে যাবার হার তখন অনেক বেড়ে যায়। ভারতের যেসব রাজ্যে তারা বেশি পরিমাণে যেতে থাকে, যেমন পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা, সেসব রাজ্যে এই আশংকা কাজ করা শুরু হয় যে সীমান্তের ওপারে একজন হিন্দু থাকা পর্যন্ত এই প্রবাহ চলতে থাকবে। প্রথমে উদ্বাস্তুর সংখ্যা শুনে মনে হয়েছে রাজ্যগুলো কেন্দ্রের সাড়া দ্রুত পেতে হয়ত সংখ্যাটি বাড়িয়ে বলছে। কিন্তু জাতিসংঘের স্থানীয় সংস্থাগুলো ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো এই সংখ্যাই যে সঠিক তা গুরুত্বাসহকারে বলেছে। বরং মোট সংখ্যার অর্ধেকরও বেশি ক্যাম্পে অবস্থান করছে বলে সহজে গণনা করা গেছে। বাকিদের সীমান্তে এবং খাবার বিতরণের স্থানে গণনা করা সম্ভব হয়েছে। গত সপ্তাহের মাঝামাঝি ভারতীয় পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের হিসেব মতে সাম্প্রতিকতম মোট সংখ্যা হলো ৪৭ লক্ষ, যার মধ্যে ২৭ লক্ষ ক্যাম্পে অবস্থান করছে এবং বাকিরা বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনের বাসায় অবস্থান করছে অথবা নিজেদের মতো ব্যবস্থা করে নিয়েছে।

ভারতের প্রাথমিক নীতি ছিল উদ্বাস্তুদের সীমান্তের কাছাকাছি সীমাবদ্ধ রাখতে। এখন সেটা আর কার্যকর নেই। ত্রিপুরার জনসংখ্যা এখন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম সীমান্ত এলাকায় বেড়ে গিয়েছে, যেসব উদ্বাস্তু ক্যাম্পে নেই তাদের কারণে শ্রমের মজুরি কমে গেছে। কিছু এলাকায়, যেমন পশ্চিমবঙ্গে, নতুন ক্যাম্প স্থাপন করার জন্য খুব সামান্যই স্থান খালি আছে। সহিংসতার হুমকি প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে কারণ ভারতীয় সীমান্তাঞ্চলের বেশিরভাগ লোকই হলো মুসলমান। ক্যাম্পগুলোর প্রশাসননিক সাফল্য ভালোই বলতে হবে, যেক্ষেত্রে সীমান্তঅঞ্চলগুলোতে কাজ করাটাই ম্যজিস্ট্রেটদের জন্য বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে এসেছে। কলেরা মাহামারি বাকি বিশ্বকে হতবাক করে দিলেও, অনেক বৈদেশিক সংস্থাই কলেরা প্রতিরোধের জন্য কয়েক সপ্তাহ যাবত কাজ শুরু করে দিয়েছে। ভারতীয় সরকারের মে মাসের কেনাকাটার তালিকায় ২৫০,০০০টি তাঁবু ও ত্রিপল থাকলেও তাকে বাড়াতে হবে, যদিও কেউই জানে না কখন প্রকৃত দাবিকে স্পর্শ করা যাবে।

যদি ভারতে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে থাকে, তবে পাকিস্তানে অবস্থা অবশ্যই তার চাইতেও খারাপ। এঅঞ্চলের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম থেকে সারা দেশের বিচ্ছিন্ন রয়েছে। শহর এবং গ্রামে জনগণের অসম চলাচল রয়েছে। গত নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষত এখনও সারিয়ে তোলা হয়নি। যানবহনগুলোকে খাদ্য-পরিবহণের পরিবর্তে সৈন্য-পরিবহণের কাজে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক এলাকাতেই বর্ষা-পরবর্তী প্রধান ফসল ধানের বীজ বপন করা হয়নি। পাকিস্তান নীতিগতভাবে পূর্বাংশে জাতিসংঘের সাহায্য গ্রহণ করতে সম্মত হয়েছে। এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত পরিবর্তন। একজন কেবল এটাই আশা করতে পারে যে, প্রক্রিয়াটিতে যেন খুব বেশি দেরি না হয়।

বাংলাদেশ নতুন আক্রমণের পরিকল্পনা করছে

দি ডেইলি টেলিগ্রাফ, ১২ জুন, ১৯৭১

নরম্যান কিরহ্যাম, কূটনৈতিক প্রতিনিধি

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

চেকোস্লোভাকিয়া ও চীনের কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের গেরিলারা পশ্চিম-পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। লন্ডনে আসা রিপোর্ট অনুসারে বলা যায়, পরবর্তী দু-মাসে হঠাৎ-আক্রমণের কৌশল নেয়া হবে।

মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে হাজার হাজার বাঙালি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে এবং গেরিলারা আশা করছে গোপন অস্ত্র-ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আরও অস্ত্র আসবে। গেরিলাদের ব্যবহৃত অনেক হালকা অস্ত্র চেকোস্লোভাকিয়ার তৈরী, কিন্তু ভারতের নাগা এলাকা থেকে কিছু চীনা অস্ত্রও দেশের ভেতরে নিয়ে আসা হয়েছে যেখানে চীন একটি আন্ডারগ্রাউন্ড বাহিনীকে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রশিক্ষণ দিয়েছে। পাকিস্তানের যুদ্ধে চীনের নীতি হলো ইয়াহিয়া খানের সরকারকে নৈতিক সমর্থন দেয়া এবং নাগা থেকে বেসরকারীভাবে অস্ত্রের সরবরাহ পিকিংকে বিব্রত অবস্থায় ফেলতে পারে।

ব্রিটিশ বন্দুক

বাংলাদেশের গেরিলারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মজুদ থেকে নিয়ে ব্রিটিশ বন্দুক এবং সেইসঙ্গে হালকা মেশিন-গান, মাইন ও হ্যান্ড গ্রেনেড ব্যবহার করছে। আর নিজেদের তৈরী বিস্ফোরক তো আছেই। তাদের তিনটি হেলিকপ্টার আছে যা এখন পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়নি এবং একটি ফিল্ড-গান আছে; কিন্তু সঙ্গের ভারী যন্ত্রপাতি নেই। তারা বরং চেষ্টা করছে সেনাবাহিনীর সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিতে। তারা গ্রামাঞ্চলে রেলের মালগাড়ি ও সেনা পরিবহনগুলো ধ্বংস করছে। গেরিলারা অনেক জেলা ও প্রদেশের কেন্দ্রগুলোয় নিয়ন্ত্রণ-প্রতিষ্ঠার দাবি করেছে। অনেক শহরে তারা তাদের নিজস্ব কারফিউ জারি করেছে।

এখন পশ্চিম-পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকা অঞ্চলে নতুন আক্রমণের আশংকা করছে। ঢাকা বিমানবন্দরের আশপাশ দিয়ে প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। বাংলাদেশী অনেক সমর্থক মনে করে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ১০০,০০০ হতে পারে কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অধিক সৈন্য ও সরঞ্জাম আনছে এবং নতুন আক্রমণের জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত রয়েছে।

এদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বেসামরিক শাসন-ব্যবস্থা প্রবর্তনের দীর্ঘ প্রতিক্ষীত প্রস্তাবনার গতকালের ভাষণ শুনতে ভালো লাগলেও পূর্ব-পাকিস্তানের আবেগগত প্রয়োজন মেটানোর জন্য তা যথেষ্ট নয়। গত তিনমাস ধরে প্রদেশটি সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে বেঁচে আছে, যেজন্য রাজনৈতিক সমাধানের পথ অনেক দূরে সরে গেছে। এই হতাশা ও ঘৃণার মুখে কী প্রয়োজন? অবশ্যই গতকাল দেয়া সতর্ক-প্রতিরোধের প্রতিশ্রুতির চাইতে উদারতাই বেশি প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের দ্বারা প্রণয়নকৃত একটি সংবিধানের চাইতে মহানুভবতা বেশি প্রয়োজন।

বাঙালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের বাইরে গিয়ে ভবিষ্যতের কোনো পরিকল্পনাই কাজে দেবে না। কেউ কেউ যদি সহযোগিতা করতে প্রস্তুতও হয় এবং তারা যদি দালাল হিসেবে প্রতিপন্ন হয়, তবে শেষ পর্যন্ত তাদের কোনো ক্ষমতাই থাকবে না। পূর্ব-পাকিস্তানে প্রেসিডেন্টের বাণীর কোনো অংশ কেউ প্রচার করতে গেলেই সে দালাল হিসেবে আখ্যা পাবে। পূর্ব-পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে এমন কোনো রাজনৈতিক সমাধানের কথা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। গতকাল ভাষণে এমন কিছু বলা হয়নি যা পোড় খাওয়া মানুষগুলোর মনোভাব পরিবর্তন করতে পারে।

সন্দেহ নেই, গত তিন মাসে যা ঘটেছে তার জন্য দায়ী করা যায় এমন অনেক লোকই আছে। কিন্তু হতভাগ্য বাঙালিরা অবশ্যই এই দায়ভাগ ভারতকে বা ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানকে বিভক্ত করতে চায় এমন কোনো ‘দুস্কৃতিকারী’কে দিতে চাইবে না। সেনাবাহিনীর কুকর্মের পেছনে কোনো সাফাই প্রেসিডেন্টের বক্তৃতায় গাওয়া হয়নি।

সম্ভবত পাকিস্তানের রাজধানীতে যা চিন্তা করা হচ্ছে তার সঙ্গে পুর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত ঘটনার মধ্যে একটা ব্যবধান রয়েছে। যদি বেসামরিক সরকারকে পুনঃস্থাপন করতে হয় তবে সম্পর্কস্থাপন করা প্রয়োজন। কিন্ত সবেক্ষেত্রেই ঘৃণাকে বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যে-এজেন্টদের নিয়োগ করা হয়েছে সেই বিহারিদের বাঙালিরা ততখানিই অপছন্দ করে যতখানি তারা পশ্চিম পাকিস্তানিদের করে। এরপরও পূর্বের সমর্থন আদায় করতে পেরেছেন এমন কর্মকর্তারা পশ্চিমে আছে। কিন্তু তারা কি ফিরে যেতে পারেন না? তাদের পুনঃনিয়োগের মাধ্যমে এটা কি প্রমাণ করা যায় না যে দমন-পীড়নের নীতি ভুল ছিল? প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের একটাই ভাবনা এবং তা হলো সবকিছুর সমাধান রাজনৈতিকভাবে হতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত গত তিন মাসে পূর্ব পাকিস্তানে যা করা হয়েছে তার ফলে সমাধানের সম্ভাবনা আরো কঠিন হয়ে পড়েছে।

এখন যা প্রয়োজন তা হলো বাঙালি জনগণের জন্য ভালো কিছু করার ইচ্ছা যার ফলে তাদের মনে হবে গেরিলা যুদ্ধ বা অন্য যাবতীয় ভোগান্তি তাদের জন্য আরো যুদ্ধাবস্থাই কেবল আনবে, তার চেয়ে শান্তিপূর্ণ আপসই ভালো হবে। তারা এমন কোনো বিবৃতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হবে না যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং যার খসড়া সেনাবাহিনীর জেনারেলদের তৈরি করা বলে মনে হবে।

বাংলায় মহামারি

দি টাইমস, ৬ জুন, ১৯৭১

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

দিনাজপুর সীমান্তে একটি উদ্বাস্তু-শিশু কলেরায় মারা গেল। সীমান্ত-শিবিরগুলোতে এর সংখ্যা ইতোমধ্যে পাঁচ হাজারে উন্নীত হয়েছে। মানচিত্রে প্রদর্শিত উদ্বাস্তুর সংখ্যা থেকে বোঝা যায় আক্রান্তের সংখ্যা মহামারি আকারে অচিন্তনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। কলকাতার লাখ লাখ উদ্বাস্তুকে আঘাত করার জন্য কলেরা খুব দূরে অবস্থান করছে না। গডফ্রে হসন-এর রিপোর্ট।

এক সপ্তাহ আগে বাংলায় নিযুক্ত অক্সফ্যাম-এর মাঠপরিচালক ফরাসী-কানাডীয় রেমন্ড করনইয়ার একটি বার্তা পেয়ে খুব হতোদ্যম হয়ে পড়েন। বার্তাটি আসে ভারতীয় নান মাদার টেরিজার কাছ থেকে কলকাতার দরিদ্রদের নিয়ে যার সেবামূলক কর্মকাণ্ড ইতোমধ্যে কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে; মাদার পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের জন্য কলকাতা থেকে ৭০ মাইল উত্তরে ও বাংলার সীমান্ত-শহর কৃষ্ণনগরে একটি মেডিকেল টিম পাঠিয়েছেন।

বার্তায় বলা হয়েছিল, “প্লিজ, স্যালাইন পাঠান; শিবিরে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে”। বাংলায় এক শতাব্দী জুড়ে কলেরা রয়েছে। কলকাতায় প্রতি বছরে কলেরায় ২,০০০ লোক মারা যায়। কিন্তু স্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞরা পুরোপুরি বুঝতে পারেন না, স্বাভাবিক সময়ে এটা কেন ঘাপটি মেরে থাকে। মাদার টেরিজার বার্তার অর্থ হলো সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়ে এটা আবির্ভূত হয়েছে। শিবিরগুলোতে জড়ো হওয়া মানুষগুলোর অনেকেরই অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় রয়েছে, দূষিত পানি ব্যবহার করছে এবং চিকিৎসা-সুবিধা বঞ্চিত। দেশত্যাগ করে আসা উদ্বাস্তুদের বেশিরভাগেরই পানিবাহিত ব্যাক্টেরিয়ার-মাধ্যমে-ছড়িয়ে-পড়া রোগ প্রতিরোধ করার মতা নেই। গত সপ্তাহের শেষে দেখা দেয়া কলেরার মহামারি আকারে রূপলাভ করাটা নিশ্চিতই ছিল।

কলেরায় আক্রান্তের ভয়াবহ পাতলা পায়খানা হয় ও বমি হয়, যার ফলে মারাত্মক পানিশূন্যতা দেখা দেয়। বমির ফলে তরল খাবার খাওয়া যায় না, তাই স্যালাইন-পানি দেহে ঢোকানোর মাধ্যমে পানিশূন্যতা রোধ করতে হয়। যদি এই পদ্ধতি দ্রুত প্রয়োগ করা যায়, এমনকি এন্টিবায়োটিক ছাড়াই, একজন সবল দেহের লোকের বেঁচে যাবার সম্ভাবনা থাকে।

মাদার টেরিজার বার্তা পাবার তারা এক ঘণ্টা মধ্যেই করনোইয়ার ও তার সহকারীরা কলকাতা থেকে ৩৫০ বোতল স্যালাইন সংগ্রহ করতে সম হন, এবং কৃষ্ণনগরের উদ্দেশে ট্রাক বোঝাই করে পাঠান। পরের দিন পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যমন্ত্রি ডাঃ আবেদিন জানান, প্রতিদিন ১,০০০ বোতল স্যালাইন দরকার কিন্তু সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৮০০ বোতল। এ-পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, প্রয়োজনের তুলনায় সরবরহ কমই রয়েছে।

খাদ্য, ওষুধ ও প্রতিষেধক-এর ঘাটতি

সোমবার পশ্চিম-বাংলার স্বাস্থ্য বিষয়ক পরিচালক ডাঃ সাহার নদীয়া ও কৃষ্ণনগর জেলার ‘ব্যাপক’ মহামারির কথা বলছিলেন। সপ্তাহান্তে কলেরায় তিনশ পঞ্চাশ জন মারা গেছে বলে সরকারি হিসেব পাওয়া গেছে। মঙ্গলবার সারা বাংলায় ৯০০ জন মারা গেছে ও বুধবার এই সংখ্যা ১৩০০-তে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং এই সংখ্যা কেবল ক্যাম্পসমূহের হিসাব। অর্ধেকে মানুষ ক্যাম্পের বাইরে রয়েছে; এবং যখন ক্যাম্পে এই অসুখ দেখা দেয় তখন ক্যাম্পের বাইরের হাজার হাজার মানুষ ভয়ে ক্যাম্প এলাকা থেকে পালিয়ে যায়, আর সঙ্গে নিয়ে যায় কলেরার জীবাণু।

ভৌগোলিকভাবে রোগজীবাণু যেভাবে ছড়াচ্ছে, তাতে ভারতীয় সরকার বলতে চাইছে যে, পূর্ব-পাকিস্তানের ভেতর থেকে রোগটি বাইরে ছড়িয়ে পড়ছে। বুধবার ইউনিসেফ জানিয়েছে ভারতীয় রাজ্য আসাম ও ত্রিপুরাতেও কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। রাজ্য দু-টি নদীয়া থেকে বহু দূরে অবস্থিত এবং পূর্ব-পাকিস্তানের ভূখণ্ড দ্বারা প্রায় বিচ্ছিন্ন। বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গ সরকার অক্সফ্যামের কাছে জানতে চাইছিল ৪০ লাখ কলেরা-প্রতিষেধক দিয়ে কত ভাগ রোগীর চিকিৎসা করানো যাবে। শুক্রবার ভারত-সরকার জেনেভায় অবস্থিত ক্যাথোলিক রিলিফ সার্ভিসেস-এর কাছে আশি টন বিভিন্ন ওষুধ চেয়ে পাঠিয়েছে এবং কলকাতার অক্সফ্যাম-অফিস অক্সফোর্ডে টেলেক্স করেছে প্লেন ভর্তি করে স্যালাইন পাঠানোর জন্য।

স্যালাইন ইঞ্জেকশন ও এন্টিবায়োটিক দিয়েই কেবল কলেরা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, যদি তা সময়মতো ধরা পড়ে ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা-পরিস্থিতি ন্যূনতমভাবে নিরাপদ থাকে। প্রতিষেধক দিয়েও একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, অবশ্য এ-পদ্ধতি শতকরা ষাট ভাগ ক্ষেত্রে কার্যকর। সুকো ইন্টারন্যাশনালের তৈরী নতুন জেট ইঞ্জেকশন প্রতিষেধক-যন্ত্র দিয়ে গণহারে প্রতিষেধক প্রয়োগ করা সম্ভব। যন্ত্রটি দিয়ে এক ঘণ্টায় একজন চিকিৎসাকর্মী ৪০০ জনকে ভ্যাক্সিন দিতে পারবেন, যেেেত্র যন্ত্রটি ছাড়া একজন ডাক্তারের ঐ পরিমাণ কাজ করতে সারাদিন লেগে যাবে।

বাংলায় এখন বিপুল পরিমাণ চিকিৎসা-যন্ত্রপাতি পাঠানো হয়েছে। অবশ্য ত্রাণকর্মীরা জানেন যতই বিপুল শোনাক না কেন, প্রয়োজনের তুলনায় তা নগন্য এবং কিছু কিছু এসেছে খুব দেরীতে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ৩০টি জেট ইঞ্জেকশন মেশিন সামনে আসছে; কিন্তু তাতে একটি মাত্র মেশিন দিয়ে দশটি ক্যাম্পের কাজ সারতে হবে। বেশিরভাগ কলেরা-প্রতিষেধক ব্রিটিশদের কাছে রয়েছে যা গতকাল পাঠানো হয়েছে; এই সংখ্যা হলো ৯০৩,০০০। এই সংখ্যার পরও চারজন উদ্বাস্তুর জন্য একটি মাত্র ভ্যাক্সিন বরাদ্দ হবে। আর উদ্বাস্তুরাই কেবল কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে, ব্যাপারটা এমনও নয়।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সব উদ্বাস্তুদের জন্য ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য রেশনের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু তার পরিমাণ অবশ্যই বেশি নয়: প্রতি লোকের জন্য প্রতিদিন এক রুপি বা এক শিলিং-এরও কম। প্রায় ৫৫ পয়সা যায় চাল ও ডালের জন্য এবং বাকিটা দিয়ে রান্নার তেল ও জ্বালানি কিনতে। সীমান্ত পার হবার সময় অনেক উদ্বাস্তুই পাঁচ বা ছয়দিন খেতে পায় নি; উপোস করা লোকজনের জন্য এই রেশন ন্যূনতম কিন্তু বাঙালিদের জন্য অনেক। এরকম ঘটনাও ঘটেছে যে ভারতীয় জনগণ অভিযোগ করেছে, সরকার দেশবাসীর চাইতে উদ্বাস্তুদের সবকিছু বেশি দিচ্ছে।

উদ্বাস্তুদের রেশন-গ্রহণের পূর্বে তালিকাভুক্ত হতে হয়। ভারতীয় সরকার তাই জানে উদ্বাস্তুর সংখ্যা কত এবং তারা কোথায় অবস্থান করছে। ত্রাণকার্য বিঘ্নিত হবার পেছনে একটা বাধা হলো উদ্বাস্তুরা পূর্ব পাকিস্তানের আশপাশে বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কলকাতার নিচের গাঙ্গেয় সমতল থেকে এক হাজার মাইল উত্তরে, হিমালয় পাদদেশের ভারী বর্ষণের এলাকা আসামী পাহাড়াঞ্চল হয়ে, আবার নিচে বার্মা সীমান্তের বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত উদ্বাস্তুদের অবস্থান।

উদ্বাস্তুরা এই সীমান্ত এলাকা জুড়ে সমানভাবে রয়েছে। জেলা ও রাজ্যসমূহকে ঘড়ির কাঁটার দিকে বিচার করলে গত সপ্তাহের শেষে যেরকম হিসেব পাওয়া গেছে তা হলো, দক্ষিণ-পূর্বের চব্বিশ পরগণা জেলায় ৪২০,০০০ জন; উত্তরের নদীয়া জেলায় ৪৫০,০০০ জন; মুর্শিদাবাদে ১,২০০,০০০ জন, যেখানে গঙ্গাই সীমান্ত হিসেবে কাজ করছে এবং যেখানে পার হওয়া কঠিন; মাদলদহে ৩০০,০০০; এবং পশ্চিম দিনাজপুরের সমতলে ১,২০০,০০০ জন। পূর্ব-পাকিস্তানের উত্তরে কুচবিহারে অন্তঃত ৭০০,০০০ জন উদ্বাস্তু রয়েছে; হিমালয়ের রেলস্টেশন দার্জিলিং থেকে বহু দূরে পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর-পূর্বের ভারতীয় রাজ্য আসামে ৩০০,০০০ জন উদ্বাস্তু রয়েছে; মেঘালয়ে আছে ৪৫০,০০০ জন; এবং ভারতীয় রাজ্যসমূহের মধ্যে সবচেয়ে দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত রাজ্য ত্রিপুরায় রয়েছে ৭০০,০০০ উদ্বাস্তু, যে-রাজ্যের নিজস্ব লোকসংখ্যাই ছিল ১,৫০০,০০০ জন।

উদ্বাস্তুদের মোট সংখ্যা এভাবে দাঁড়াচ্ছে অন্তঃত ৪,৬৬০,০০০ জন: কারণ কিছু সচ্ছল লোক কলকাতা বা ছোট শহরগুলোতে প্রবেশ করতে পেরেছে যাদের রেশনের জন্য তালিকাভুক্তির প্রয়োজন নেই। এবং উদ্বাস্তুর সংখ্যা প্রতিদিন ১০০,০০০ করে বাড়ছে। কিন্তু এই বিশাল সংখ্যা পুরো সমস্যার অর্ধেকও নির্দেশ করে না। অনেক পশ্চিমা ত্রাণ-কর্মকর্তা মনে করেন, পূর্ব-পাকিস্তানে একজন হিন্দু অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত এই দেশত্যাগের প্রক্রিয়া চলবে। এই প্রকিয়া শুরু হবার পূর্বে, পূর্ব-পাকিস্তানে মোট হিন্দুর সংখ্যা ছিল এক কোটি।

পূর্ব-পাকিস্তানে সমস্যা শুরু হবার পর থেকে উদ্বাস্তুদের তিনটি ঢেউ সীমান্তে এসে পড়ে। ২৫ মার্চে পশ্চিম-পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আক্রমণ করার পরপরই এক দফায় প্রধানত হিন্দুরা (এবং বাঙালিরাও) উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই প্রথম দফায় কিছু মুসলমানও উদ্বাস্তু হয়। দ্বিতীয় ঢেউটি আসে মে মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষ দিকে; এবং তৃতীয় ঢেউটি আসে গত সপ্তাহান্তে। উভয় ক্ষেত্রেই উদ্বাস্তুদের বেশিরভাগই ছিল হিন্দু। উদ্বাস্তুদের চোখে-মুখে ভয়-ভীতির সব চিহ্নই রয়েছে। দি সানডে টাইমস্ হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড-এর বাংলাভাষী রিপোর্টারদের মাধ্যমে অনেক উদ্বাস্তুর সাক্ষাৎকারের আয়োজন করে।

বর্ষা শুরু হবার পর নতুন বিপদ

সংবাদপত্রের ব্যবস্থাপনা-সম্পাদক অভীক সরকার বললেন, উদ্বাস্তুরা “ব্যর্থ বিপ্লবের নিষ্ঠুর স্মৃতি” নিয়ে এসেছে―যে বিপ্লব ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য―এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সহিংসতার জন্যও। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ভারতীয় সাংবাদিকরা যেমন বলে থাকে, গণহত্যার এই ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে। মি. সরকার লিখছেন, “একটি ভারত-বিরোধী পরিকল্পিত প্রচারণা এখানে চালানো হয়েছে এবং সীমান্ত অতিক্রম করে পালিয়ে না-যাবার কোনো পথ সেনাবাহিনী রাখে নি। নিষ্ঠুরতার একটি বড়ো অংশ হলো হিন্দুদের উদ্বাস্তুতে পরিণত করা”।

প্রতিবেদকরা যা বারবার লিখছেন তার দুটো উদাহরণ পাওয়া গেল। ৮০ বছরের শরৎ দাস বললেন, একদিন তার চল্লিশ বছর বয়েসী ছেলে, যে পেশায় মুচি, কাজ থেকে বাড়ি ফেরে নি। তিনি বললেন তার সন্তানকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। সুধারানি ঘোষ বললেন তার স্বামীকে মুসলিম লিগের কর্মীরা বাড়ি থেকে ডেকে রাস্তায় নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলে। এই কাহিনীগুলো অভিযোগ পুরোপুরিভাবে প্রমাণিত করে না। কিন্তু এগুলো এটা অন্তঃত প্রমাণ করে উদ্বাস্তুরা ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছে এবং যতদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলায় থাকবে ততদিন তারা দেশে ফিরে যাবে না। একজন উদ্বাস্তুকে জিজ্ঞেস করা হলো সে কেন ফিরে যাবে না। সে বলল “আমি তখনই ফিরে যাবো যখন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হবে।” কোনো সন্দেহ নেই, সে সংখ্যাগরিষ্ঠ উদ্বাস্তুর কথাই বলেছে।

ভারতীয় সরকার সরকারীভাবে তাদের ‘উদ্বাস্তু’ বলার পরিবর্তে ‘স্থানান্তরকারী’ বললেও পুরো ব্যাপারটা থেকে উদ্ভূত সমস্যাকে এড়াতে পারছে না। পাঁচ মিলিয়ন উদ্বাস্তুর কারণে ইতোমধ্যেই প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এরপরও আরো পাঁচ মিলিয়ন উদ্বাস্ত সীমান্ত অতিক্রম করবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। কিন্তু ভারতীয় সরকারের মনোভাব বাস্তবানুগ না হলেও তা সহজেই বোধগম্য। উদ্বাস্তুরা যে দলে দলে এসেছে তা ভারতের অপরাধ নয়। এসবকিছুর কারণ হলো, পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছে তার কারণেই সমস্যাগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। তার চাইতেও বড়ো কথা হলো, পাকিস্তানি সরকার এবং সেনাবাহিনীই এসবকিছুর জন্য দায়ী।

কিন্তু, ভারত-সরকারের ওপরেও নানা দিক থেকে উদ্বাস্তু-সমস্যা নিয়ে নানা ধরনের চাপ রয়েছে, এবং যদি সম্ভব হয়, ভারত-সরকারকে এসমস্যা থেকে মুক্ত হতে হবে। স্থানীয় ভারতীয় জনগণ ইতোমধ্যে অভিযোগ করেছে যে, উদ্বাস্তুরা কাজকর্ম খোঁজা শুরু করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিবিদরা ইতোমধ্যে সতর্ক হয়ে গেছেন যে, উদ্বাস্তু-শিবিরগুলো হয়ত নকশালপন্থীদের আখড়া হয়ে যাবে; নকশালপন্থীদের কর্মকাণ্ডের নিদর্শনও এরমধ্যে দেখা গেছে― ক্যাম্পগুলোতে রাজনৈতিক খুনোখুনি হয়েছে।

ভারতীয় সরকার এই জনবিস্ফোরণকে মোকাবেলা করার জন্য ব্যাপক পদপে নিয়েছে, যদিও কেন্দ্রীয় বা রাজ্য-সরকারের হাতে সম্পদ খুব সীমিত। বিশেষ করে ত্রিপুরা সরকার বিরাট সব পদপে নিয়েছে: ২৬টি স্থায়ী শিবিরে তারা কাজ করা শুরু করে দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বেসরকারী ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে যারা ট্রাকের বহর দিয়ে সীমান্ত-শিবিরগুলোতে খাদ্য পৌঁছে দেবে। অক্সফ্যাম ছাড়াও বেশ কিছু বেসরকারী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নিজ নিজ পদ্ধতিতে কাজ করে যাচ্ছে: পশ্চিমবঙ্গ রেডক্রস, ইউনিসেফ, ওয়ার অন ওয়ান্ট, সেভ দ্য চিলড্রেন ফান্ড, ক্যাথোলিক রিলিফ সার্ভিসেস, দি ক্রিশ্চিয়ান এজেন্সি ফর সোশ্যাল এইড, ক্রিশ্চিয়ান এইড, কেয়ার এবং চার্চসমূহ। কিন্তু বেশিরভাগ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মকর্তারা সম্ভবত রেমন্ড কোরনয়ারের গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যকে মেনে নেবেন, “স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো যা করছে, তা হলো, একটি বালতিতে এক ফোঁটা পানি”। সংস্থাগুলোর অবদানকে এভাবে হিসেব করা যাবে যে, যখন শত শত ডাক্তারের প্রয়োজন তখন তিনজন এখানে, চারজন ওখানে কাজ করছে; আর যেখানে লাখ লাখ লোক ক্ষুধার্ত, তখন হাজার লোককে খাওয়ানো যাচ্ছে।

দুর্ভাগ্যবশত, বিশ্বের সরকারগুলো সময়মতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় নি। তিন সপ্তাহ আগেই উ থান্ট জাতিসংঘের উদ্বাস্তু-কমিটিতে জরুরিভিত্তিতে বিশেষ সাহায্য প্রদানের জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। জাতিসংঘের দেয় তথ্যানুসারে কেবল চারটি দেশ সাহায্য দিয়েছে বা প্রতিশ্র“তি প্রদান করেছে। আবেদনটির পরপরই ব্রিটেন প্রাথমিক সাহায্য হিসেবে এক মিলিয়ন পাউন্ড প্রদান করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ২.৫ মিলিয়ন ডলার প্রদান করেছে যার মধ্যে ৫০০,০০০ ডলার ইতোমধ্যে জাতিসংঘ-কমিটিকে দিয়ে দেয়া হয়েছে। কানাডা ২ মিলিয়ন ডলার প্রদান করার প্রতিশ্র“তি দিয়েছে খাদ্য- ও স্বাস্থ্য- সংক্রান্ত সাহায্য হিসেবে, এবং পশ্চিম-জার্মানি ১ মিলিয়ন ডয়েস মার্ক দিয়ে শুরু করতে চেয়েছে। জাতিসংঘের অন্য ১৫০টি দেশের কেউই সাড়া দেয় নি― যদিও, সত্যি কথা বললে, সুইডেন সাহায্য দিয়েছে কিন্তু তা দিয়েছে রেড ক্রিসেন্টের মাধ্যমে।

রেমন্ড কোরনেয়ার বলেন, “যদি বর্ষা শুরু হয়, আপনি আশা করতে পারেন না যে লোকজন বাইরে খোলা আকাশের নিচে দু-দিন ধরে থাকবে”। লাখ লাখ লোকই খোলা আকাশে নিচে ঘুমায়। উদ্বাস্তুদের মাত্র অর্ধেকই ক্যাম্পের ভেতরে থাকতে পারে। ভরা বর্ষা শুরু হবার আগে আশ্রয়-কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, সম্ভবত, কেবল ভারতীয় সেনাবাহিনীরই আছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হবার কারণে সেনাবাহিনী সীমান্তগুলো পাহারা দিতে ব্যস্ত রয়েছে। বর্ষা আসার আগে যদি কলেরাকে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, মহামারি শুরু হয়ে যাবে; বন্যা হলে বা জলভাগের উচ্চতা বেড়ে গেলে ব্যাক্টেরিয়া দ্রুত বিস্তার লাভ করবে। এভাবে বর্ষা নতুন একটি বিপদ ডেকে নিয়ে আসবে: সেটা হলো টাইফয়েড। খুব সামান্যই টাইফয়েডবিরোধী সিরাম পাঠানো হয়েছে। বাংলার দুর্ভোগ কেবল বর্ষাতেই থেমে থাকবে না। পূর্ব পাকিস্তানে বর্ষার পূর্বেই ধানের বীজ রোপন করা হয়ে থাকে। কিন্তু যুদ্ধ ও দেশত্যাগের কারণে লাখ লাখ কৃষক এই বসন্তে কোনো কোনো ধান চাষ করতে পারে নি। আক্রমণ, নিপীড়ন এবং মৃত্যুর পর চতুর্থ যে অশুভ শক্তি পূর্ব বাংলায় আসবে, তা হলো, দুর্ভিক্ষ।

ত্রাণকর্মীরা অপোকৃত নিকবর্তী বিপদ মোকাবেলায় ব্যস্ত রয়েছে। কলকাতায় কলেরা ছড়িয়ে পড়ছে। এই মারি এমন একটি শহরে ছড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে যার জনসংখ্যা কতো তা কেউ জানে না― এবছরে সম্ভবত আট মিলিয়িন এবং এদশকের শেষে ১২ মিলিয়ন। শহরটির তিন-চতুর্থাংশেই সুয়ারেজ বা চলমান পানি-ব্যবস্থায় ঘাটতি আছে। প্রতি বর্ষায় এখানে জলাবদ্ধতা হয়। ভারতীয় সরকার শহরটিতে কলেরার অনুপ্রবেশে খুবই উদ্বিগ্ন। দমদম এয়ারপোর্টের একেবারে শেষ মাথায় অন্তঃত ৩০,০০০ উদ্বাস্তু এসে আসন গেড়েছে। শহরের আরও কাছাকাছি, উত্তরাংশে অবস্থিত শান্তি-শহরে আরেকটি উদ্বাস্তু-কলোনি আছে যেখানে আরো কয়েক হাজার বেশি উদ্বাস্ত আছে।

শহর থেকে খুব সম্প্রতি ঘুরে আসা অক্সফ্যামের দুর্যোগ-ব্যস্থাপনা-কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার মাইকেল ব্ল্যাকম্যান বলেন, “আমি মনে করি কলকাতায় যদি কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, তবে খোদা না করুক, এটা লন্ডনের মহা-প্লেগ হয়ে দেখা দিবে। রেমন্ড করোনেয়ার বলেন, “সে’স্ট উন ফিউ দি ফরেস্ট (এটা হবে দাবানলের মতো)। এটা কতটা ভয়ংকর হবে তা বলার মতো কোনো যথার্থ ভাষা আমার জানা নেই। কলকাতায় ঘিরে যদি এটা একবার ছড়িয়ে পড়ে, উভয় বাংলার গোটা জনগোষ্ঠীই ধ্বংস হবার মুখে পড়বে”। উভয় বাংলায় ১১০ মিলিয়ন মানুষ রয়েছে, যা গোটা মানবগোষ্ঠীর শতকরা তিন ভাগের সমান।

ইয়াহিয়ার শিকার শেষ কয়েক লক্ষ

দি গার্ডিয়ান, ৫ জুন, ১৯৭১

সম্পাদকীয়

পূর্ব-পাকিস্তানের হতভাগ্য লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন খুব দেরিতে এসেছে। রাজনীতি, আমলাতন্ত্র ও দমননীতি ভারতের হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে — যেন ভারতের নিজেরই এধরনের সমস্যা নেই — তাকে একাই ৪০ লক্ষ উদ্বাস্তুর দেখাশোনা করতে হচ্ছে। অনেকের জন্য কলেরা হলো দুর্যোগের চতুর্থ ধাপ –এর আগে তাদের ভাগ্যে ছিল তিন দুর্যোগ: গত নভেম্বরের সাইক্লোন, ইয়াহিয়া খানের সামরিক হত্যাভিযান এবং জনগণের উদ্বাস্তুতে রূপান্তরিত হওয়া। এখনকার সমস্যা হলো পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্ব পাকিস্তানের যাদের সাহায্য প্রয়োজন, যত দ্রুত সম্ভব তাদের সাহায্য-প্রদান নিশ্চিত করা।

দুই এলাকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পৃথক। পূর্ব-পাকিস্তানের মতো পশ্চিমবঙ্গের কোথাও চলে যাওয়ার সমস্যা নেই। ভারতকে দ্রুত দেখাতে হবে যে তার একার পক্ষে উদ্বাস্তুদের দেখাশোনা করা সম্ভব না। ভারত বাইরের সহায়তাকে স্বাগত জানিয়েছে। সাহায্য যা আসবে তা দিয়ে হয়তো পুরো প্রয়োজন মিটবে না। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো ভারত-সরকার জাতিসংঘের কাছে সাহায্য-প্রার্থনা করেনি। এই আমলাতান্ত্রিক বাধার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুরা অনেক সহায়তাই পাচ্ছে না।

পূর্ব পাকিস্তানে যাদের হত্য করা হয়নি, কিন্তু এই মুহূর্তে ক্ষুধার্ত রয়েছে, তাদের জরুরিভিত্তিতে খাদ্য প্রয়োজন। কিন্তু ইয়াহিয়া খানকে সরাসরি সাহায্য ব্যতিরেকে তাদের কীভাবে সাহায্য করা হবে? নাইজেরিয়ার বায়াফ্রার জন্য যখন আন্তর্জাতিক সাহায্য দেয়া হয়েছিল তখন জেনারেল গাওন অযৌক্তিকভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন এই বলে যে সাহায্যদানকারীরা তার শাসনপদ্ধতিতে অন্যায় হস্তপে করেছেন। ইয়াহিয়া খান এসবেরই লক্ষণ দেখাচ্ছেন — বলছেন পাকিস্তানের নিজস্ব সংস্থাসমূহ সাহায্য পরিচালনা করে। কিন্তু তিনি এবং দাতারা জানেন, এভাবে সাহায্য দেয়ার অর্থ, সেনাবাহিনীর হাতে তা দেয়া, যে-সেনাবাহিনী দুর্গতদের হত্যাকারীর ভূমিকা পালন করে এসেছে।

সাহায্যদাতারা ইয়াহিয়ার মহত্ত্বের ভান করাটাকে এড়িয়ে চলতে পারেন যদি বিশ্বের অর্থসংস্থাসমূহ তাকে শর্তহীনভাবে নাকচ করে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। পাকিস্তানের অর্থনীতি এখন খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছে এবং অবমূল্যায়ন প্রকট হয়ে উঠেছে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও অর্থসংস্থাসমূহের কাছে সাহায্য চাওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকে এখানে নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে নিশ্চিত করতে হবে যে, ইয়াহিয়া খান যেন বাড়তি কোনো সাহায্য না পান, যা তিনি চাচ্ছেন। ইয়াহিয়া খানকে এটা স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে যে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে যে-দমননীতি চালিয়ে যাচ্ছেন, তাতে সাহায্য করার জন্য তার পাশে কেউ নেই। পরিতাপের বিষয় এই যে, যখন এই রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা হবে, ইতোমধ্যে আরও উদ্বাস্তু দেশ ছাড়বে এবং খেতে না পেয়ে আরও অনেক মানুষ মারা যাবে।

ভোগান্তির উদ্দেশ্যে যাত্রা

দি গার্ডিয়ান, ৫ জুন, ১৯৭১

এ বি ইউ

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

গত সপ্তাহে যখন আমি আগরতলা-সার্কিট-হাউসে ছিলাম, রাতের বেলায় আমার বেডরুমের জানালা কেঁপে উঠত; কারণ প্রতি রাতে সীমান্ত বরাবর পাকিস্তানি শেল বিস্ফোরিত হতো। আগরতলা হলো ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী, পূর্ব পাকিস্তানের পাঁচটি জেলার সঙ্গে যে-রাজ্যটির সীমান্তরেখা আছে। দিনের বেলাতেও শেল বিস্ফোরন হতো যদিও তার সংখ্যা কম ছিল। সীমান্তে অবস্থানরত গেরিলাদের উদ্দেশ্যেই এই বোমা নিক্ষেপ করা হতো, কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই, এসব এলাকার গ্রামবাসীদের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করার জন্য ভীতি-প্রদর্শনেও শেল ফাটানো হতো।

গত কয়েক দিনে যেহেতু সীমান্ত জুড়ে পাকিস্তানি সৈন্য-সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরা, পশ্চিম-বাংলা ও আসামে উদ্বাস্তুর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পূর্ব-বাংলা থেকে প্রায় ৩০ লক্ষ শরণার্থী এখন ভারতে অবস্থান করছে। দু-মাস আগে ত্রিপুরার জনসংখ্যা ১৫ লক্ষ ছিল, বর্তমানে তার প্রায় অর্ধেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

আশ্রয়-শিবির

ত্রিপুরায় ৫০০,০০০-এরও বেশি নিবন্ধীকৃত উদ্বাস্তু রয়েছে, এছাড়া অনিবন্ধীকৃত প্রায় ১০০,০০০ শরণার্থী আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে অবস্থান করছে। এ-পরিস্থিতিতে সাংঘাতিক খাদ্য-সমস্যা দেখা দিয়েছে এবং উন্নয়ন-প্রকল্পসমূহের গতি মন্থর হয়ে গেছে। এক হিসেবে অর্ধেক শরণার্থীকে অস্থায়ী আশ্রয়-শিবির প্রদান করা হয়েছে। অনেক স্কুল ও মন্দির ক্যাম্পে রূপান্তরিত হয়েছে, কিন্তু হাজার হাজার লোককে চাটাই- ও খড়-নির্মিত কুঁড়েঘরে থাকতে হচ্ছে। ঘরগুলোকে দেখে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন মনে হয়, কিন্তু ঝড়ে তা সহজেই উড়ে যেতে পারে। মধ্য-জুনে প্রবল বৃষ্টি হলে সেগুলো রা করা দায় হবে। হাজার হাজার পরিবার গাছতলায় ও খোলা জায়গায় অবস্থান করছে এবং সামনের সপ্তাহগুলোতে অনেক শিশু মারা যাবে।

আগরতলা থেকে ৭০ মাইল দক্ষিণে সাবরাম-এ ত্রিপুরার বৃহত্তম ক্যাম্পটি অবস্থিত। ২,০০০ জনসংখ্যার শহরটিতে এখন অধিবাসীর সংখ্যা পূর্বের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। গত মাসে প্রায় ৮০,০০০ লোক সাবরাম হয়ে এসেছে। ক্যাম্প থেকে কয়েক হাজার গজ দূরে ফেনী নদী পূর্ব-বাংলার সঙ্গে সীমানা নির্দেশ করছে। ভারতীয় তীরে একটি ছইওয়ালা ছোট্ট নৌকা বাঁধা। একদল বাচ্চ-কাচ্চা নদীর অপর পাশটা দেখছিল। ‘ঐযে!’ একজন চিৎকার করে উঠল, ‘ঐযে ওরা যায়’। দু-জন পাকিস্তানি অফিসার একসময়ের-ডাকঘর-বর্তমানের-সেনাবাহিনী-ক্যাম্পের চত্বরের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল। ওটা হলো রামগড় শহর। সেখানে অন্য কোনো শব্দ নেই। ডাকঘরের পেছনে বিস্তৃত খালি জায়গা। এরপর আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত স্কুলভবন ও অর্ধেক বিধ্বস্ত মসজিদ। কাছেই, অল্পকিছু ঘর-বাড়ি দেখা যায়।

কলকাতা থেকে ৬০ মাইল দূরে এবং ভারতীয় সীমানার দু-মাইল ভেতরে ভয়াবহ দৃশ্য দেখা যায়, যেখানে হাজার হাজার মা কোলে শিশু নিয়ে রাস্তার ধারে খোলা আকাশের নিচে বসে আছে, রান্না-বান্না করছে অথবা ছায়ার নিচে বিশ্রাম নিচ্ছে। দুর্ভাগ্য তাদের মুখমণ্ডলেই লেখা রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে লোকজন লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে প্রতিদিনের ৪০০ গ্রাম চালের রেশনের জন্য। শরণার্থীদের বৃহৎ অংশই শিশু। অনাহারে শীর্ণ, নিরব, মনমরা বাচ্চাদের এক হৃদয়বিরাক দৃশ্য সেটা। এমন এক দুর্ভাগা জগতে তারা জন্ম নিয়েছে, যার জন্য তারা দায়ী নয়।

কিন্তু, বাচ্চারা আহত করলেও তাদের মুক্তিবাহিনীর বড়ো ভাইয়েরা সবাইকে উজ্জীবিত করে। সীমান্ত এলাকায় আগরতলা থেকে কয়েক মাইল দূরে আমি এক বনের প্রান্তে একটি মুক্তি ফৌজ ট্রেনিং-ক্যাম্পে এক ঘণ্টা কাটাই। লুঙ্গি ও শার্ট পরিহিতদের সশস্ত্র পাহারা পেরিয়ে আমাকে একটি কাঠের পুরনো ভবনের সামনে আনা হয়, যেখানে একজন তরুণের সঙ্গে দেখা হয়, যার বয়স বড়োজোর ১৮ বছর হবে। তিনি নিজেকে কমান্ডার হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি ঢাকার মিলিটারির একাডেমির একজন সাবেক ক্যাডেট। তিনি তার নেতৃত্বাধীন কিছু যোদ্ধার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন যারা সবাই ছাত্র-বয়েসী, এবং শার্ট-লুঙ্গি পরিহিত। তাদের একজন রাইফেলের স্তূপ পাহারা দিচ্ছে। কমান্ডার যোদ্ধাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দিচ্ছিলেন, পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে প্রতিদিনের যুদ্ধের কথা বলছিলেন। তিনি বিজয়ের ব্যাপারে আত্মপ্রত্যয়ী। কমান্ডার বললেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের মানসিক জোর প্রচণ্ড’। তিনি বারবার একথা বললেন। যখন আমি ড্রয়িংটা শেষ করলাম, তিনি এসে তা দেখলেন। (এই রিপোর্টের সঙ্গে একটি স্কেচ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়) ‘তাকে সন্ত্রস্ত দেখাবেন না’, কমান্ডার বললেন। ‘তার চোখে আপনি অবশ্যই সাহসের চিহ্ন দেখাবেন। আমাদের মনের জোর খুবই বেশি’। ছেলেটাকে যেমন দেখাচ্ছিল, আমি তেমনই এঁকেছি। মনে হয় সে তার মায়ের কথা ভাবছিল।

পূর্ব-পাকিস্তানের অপরাধীদের ও ধ্বংসযজ্ঞের ওপর গোপন ক্যাটালগ

দি টাইমস, ৪ জুন, ১৯৭১

পিটার হ্যাজেলহার্স্ট

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা হঠাৎ করেই আন্তর্জাতিক সমস্যাযুক্ত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। গৃহযদ্ধের কারণে লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ ও রোগবালাই দেখা দিয়েছে এবং যেকোনো সময় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ শুরু হবার আশংকা সৃষ্টি হয়েছে। তবে সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার হলো, বর্তমান অবস্থা থেকে পরিস্থিতির কেবল অবনতিই হতে পারে। বিশ্বনেতারা অবশ্যই আন্তরিকতার সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন কীভাবে পূর্ব বাঙালিরা এবং পশ্চিম পাকিস্তানীরা একটি ‘রাজনৈতিক সমাধান’-এ পৌঁছতে পারে। কিন্তু পাকিস্তান-ঘটনাবলীর একজন সবচাইতে উদাসীন ছাত্রও জানেন রাজনৈতিক সমঝোতার ব্যাপারটি এখন প্রশ্নাতীত একটা ব্যাপার।

সামনের মাসগুলোয় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে এবং বিশ্বের রাজধানীগুলোতে মানুষের তৈরি এই ধ্বংসলীলার বিরুদ্ধে কী কী আইনগত পদক্ষেপ নেয়া যাবে তা নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক চলবে। কিন্তু এই যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টির জন্য যেসকল ইস্যু রয়েছে সেগুলো ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ ও ‘গণহত্যা’ এবং অন্যান্য অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের কারণে আরো ঘোলাটে হয়ে উঠেছে; এবং এই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য পাকিস্তানী কোনো নেতার দিকে যদি কেউ অভিযোগের অঙ্গুলি তোলেন তবে, বলা যায়, তিনি ঠিক কাজটিই করবেন।

প্রসঙ্গত ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসের কথা তোলা যায়, যখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জনগণের মাধ্যমে নির্বাচিত একটি সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এবং একটি নির্বাচিত সাংবিধানিক সংসদের লোভ দেখিয়ে তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। সংবিধান-প্রস্তুতের প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করার জন্য এবং পশ্চিম-পাকিস্তানীদের (যারা এক-পাকিস্তানে বিশ্বাস করে ও পূর্ব-পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কারণে যা বিপজ্জনক অবস্থায় এসে পৌঁছেছিল) ভয় কমাতে, এর আগে প্রেসিডেন্ট একটি লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও) জারি করেছিলেন যা তাকে সংবিধান অনুমোদন বা বাতিল করার ক্ষমতা দিয়েছিল।

ইতোমধ্যে এটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে পশ্চিম পাকিস্তানে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রি মি. ভুট্টো সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে আবির্ভুত হবেন এবং অগ্নিগর্ভ পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমান ইতোমধ্যে তার ক্ষমতা প্রদর্শন করেছেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন তুমুলভাবে চলছে তখন রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, উভয় নেতাই নিজ নিজ প্রদেশে তাদের মাথা খাটানো শুরু করেন এবং পাকিস্তানীরা সামনের দিকে চেয়ে গণতন্ত্রের প্রথম স্বাদ পাবার অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু যখন দুই নেতা তাদের নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু করেন, এটা দ্রুত পরিস্কার হয়ে গেল যে তারা কঠোর ও বিপরীত দুই অবস্থান থেকে কথা বলছেন; আর সংসদে একই অবস্থান থেকে খুব কমই কথা হবে। মি. ভুট্টোর রাজনৈতিক শক্তি দাঁড়িয়ে আছে কাশ্মীর-বিতর্ক নিয়ে জঙ্গি পাঞ্জাবিদের মোহের ওপর, এবং তিনি পশ্চিমের প্রদেশগুলোতে এই বিষয়টিকেই কাজে লাগাতে শুরু করেন, ভারতের সঙ্গে হাজার বছরের যুদ্ধের কথা বলেন। এবং এই মনোভঙ্গি রক্ষার জন্য তিনি শক্তিশালী সেনাবাহিনীর কথা বলেন, কাশ্মীরকে স্বাধীন করার জন্য অধিক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে ভোট চান।

গত বছর দেশের প্রথম অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ইয়াহিয়া খান ও তার অনুসারীরা নির্বাচনের ফলাফল কী হয় তা নিয়ে বেশ উৎকণ্ঠিত ছিলেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নিশ্চয়ই মতা হস্তান্তরের ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তিনি আশা করেছিলেন নির্বাচনের ফলাফল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের একটি জোট-সরকার গঠন করতে বাধ্য করবে এবং এভাবেই পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা পাবে। কিন্তু জেনারেলরা দু’টি বিষয় বিবেচনায় আনেন নি। শেষ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বামপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নির্বাচন বয়কট করে এবং একারণে আওয়ামী লীগের জন্য পুরো মাঠ ফাঁকা হয়ে যায়। অন্যদিকে সাইক্লোনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান প্রশাসন সময়মতো ত্রাণ সরবরাহ করতে পারে নি বলে ভোট সব আওয়ামী লীগের পক্ষেই যায়, এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতা রার প্রশ্নে নির্বাচনের ফলাফল ছিল বিপর্যয়মূলক।
প্রায় প্রত্যেক বাঙালিই শেখ মুজিবের ছয়-দফা-কর্মসূচিকে গ্রহণ করেছিল এবং নির্বাচনের ক্ষেত্রে তা মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। আওয়ামী লীগ বাঙালিদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জয়লাভ করে এবং পশ্চিমা প্রদেশের পাঞ্জাব-বিরোধী আঞ্চলিক দলসমূহের সমর্থন নিয়ে ৩১৩টি আসনের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসন নিয়ে সরকার গঠনের ব্যাপরে শেখ মুজিব আস্থাবান ছিলেন। পশ্চিমাংশে মি. ভুট্টোর পিপলস পার্টি ১৩৮টি আসনের মধ্যে ৮২টি আসন লাভ করে। পাঞ্জাবি লোকটি এই ভেবে শংকিত হয়ে উঠেছিলেন যে সংসদ বসলে বাঙালিরা তাদের নিজের মতো করে সংবিধান রচনা করবে।

কিন্তু মি. ভুট্টো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রি হতে পারবেন না বুঝতে পেরে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবেছিলেন। তিনি হঠাৎ আবিষ্কার করলেন যে প্রেসিডেন্টের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের (এলএফও) মধ্যে তার স্বার্থ লুকিয়ে রয়েছে। সংসদকে ভেটো দেবার বা বাতিল করার যে-ধারাটি রয়েছে, তা এক অর্থে পাঞ্জাবেরই ভেটো। নির্বাচনের পরের রাতে এই ধুরন্ধর আইনজীবী আমার কাছে তার পরিকল্পনা প্রকাশ করেন: ‘আমি কী করব তা নিয় আপনি কী ভাবছেন? শেখ তার সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে তার নিজের সংবিধান রচনা করবে আর সব দায়-দায়িত্ব গিয়ে পড়বে প্রেসিডেন্টের ঘাড়ে। পশ্চিম-পকিস্তানে অগ্রহণযোগ্য কোনো কিছুতে তিনি স্বীকার করবেন কি না তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।’

অন্য অর্থে, এলএফও-কে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে মি. ভুট্টোর স্বার্থ রয়েছে। কিন্ত তিনি আমাকে বলেন তিনি গোপন খবর পেয়েছেন যে শেখ মুজিব ঘোষণা করেছেন সাংবিধানিক সংসদ অধিবেশনে বসার সঙ্গে সঙ্গে একটি সার্বভৌম সংস্থাতে পরিণত হবে। অন্য কথায় এলএফও এবং পাঞ্জাবি ভেটো তখন থেকে অকার্যকর হয়ে পড়বে। ইতোমধ্যে বাঙালিদের মধ্যে উৎসবের আমেজ চলে এসেছে এবং তাদের দিক থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদের কোনো কর্মকাণ্ড ছিল না। ডিসেম্বরের ২৪ তারিখে ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে ‘আমাদের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রি’ হিসেবে বর্ণনা করেন এবং সংসদ ঢাকায় বসার ব্যাপারে সম্মত হন। বাঙালিরা সংসদভবন ও শহরকে সাজাতে শুরু করেছিল এবং ঢাকার মেজাজ ছিল বিশ্রামমুখর। বাংলাদেশের স্লোগান আর দেয়া হয়নি এবং কেউই স্বাধীনতার কথা আর বলছিল না। কিন্তু মি. ভুট্টোর অন্য ভাবনা ছিল। প্রথমে তিনি শিগগীরই সংসদে বসার বিরোধিতা করেন কিন্তু ১৩ ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দেন যে ৩ মার্চ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসবে।

কিন্তু দু-দিন পরে ১৫ ফেব্রুয়ারি ফিরে যাবার ক্ষেত্রে প্রকৃত সমস্যা সৃষ্টি হয়। মি. ভুট্টো ঘোষণা দেন যে তার দল সংসদে যাবে না এবং একইসঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের যারা ঢাকা যাবার পরিকল্পনা করছেন তাদের হুমকি দেন। সংক্ষেপে বলা যায় মি. ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে চাপ প্রয়োগ করেন। সাথে সাথে তিনি ইয়াহিয়ার জেনারেলদের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন যারা পূর্ব-বাংলার ব্যাপারে কট্টরপন্থী। পূর্ব-বাংলার বর্তমান গভর্নর জেনারেল টিক্কা খানও এদের মধ্যে রয়েছেন।

ইতোমধ্যে অনেক নির্বাচিত পশ্চিম-পাকিস্তানী সাংসদ মি. ভুট্টোর হুমকি উপেক্ষা করে সংবিধান রচনায় অংশ নিতে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ঢাকা গিয়েছেন। গাণিতিক হিসেব অনুযায়ী দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য ঢাকার সংসদে জড়ো হয়েছিলেন। কিন্তু ২৮ ফেব্রুয়ারি মি. ভুট্টো রাওয়ালাপিন্ডি উড়ে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে স্মরণ করিয়ে দেন, পাঞ্জাবি সেনাবাহিনীর কাছে অগ্রহণযোগ্য কোনো সংবিধানকে অনুমোদন দিলে তাকে ভবিষ্যতে কী কী বিষয় মোকাবেলা করতে হবে। প্রেসিডেন্ট তার ভুলটি করলেন। তিনি পাঞ্জাবি চাপের কাছে নতি স্বীকার করেন এবং বৃহত্তর দলের নেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে কোনো রকম পরামর্শ না করেই পয়লা মার্চ সংসদ বাতিল করে দেন।

বাঙালিরা দেখল পুরো ব্যাপারটা একটা ষড়যন্ত্র, তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল এবং ঢাকার বিশৃঙ্খলা দমন করতে সেনাবাহিনী তলব করা হল। বাঙালিরা প্রেসিডেন্টের ওপরে আস্থা হারালো এবং ঢাকার রাজপথে বাংলাদেশের জন্য প্রথম চিৎকার শোনা গেল। আওয়ামী লীগের উত্তেজিত সমর্থকরা স্বাধীনতা ডাকা শুরু করে দিল এবং শেখ মুজিব ৭ মার্চের গণবিক্ষোভের দিনে নাটকীয় ঘোষণার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। ৬ মার্চ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ঘোষণা দেন ২৫ মার্চ সংসদ ডাকা হবে। কিন্তু ততক্ষণে জল অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়েছে। পরের দিন শেখ স্বাধীনতার জন্য জঙ্গি আন্দোলনের ডাক দেন এবং ভবিষ্যতে কোনো আলোচনার জন্য চারটি পূর্বশর্তের কথা বলেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পূর্বশর্ত ছিল সামরিক শাসন প্রত্যাহার (এলএফও-র কল্যাণে নিশ্চিত মি. ভুট্টোর মতা তাতে শেষ হয়ে যাবে)।

এই ডামাডোলের মধ্যে একটা জিনিস পরিস্কার: অনেক চাপ মোকাবেলা করা সত্ত্বেও শেখ একক পাকিস্তানে অংশ নেবার পক্ষে ছিলেন। তিনি নিশ্চয়ই ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে (বাঙালিরা এক্ষেত্রে ওকালতি করেছিল) কাশ্মীর ইস্যুতে আপস করতেন না এবং তিনি বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিও অগ্রাহ্য করেন যার মাধ্যমে কেন্দ্রের কার্যকর ক্ষমতাকে বাতিল করে দিত। পাঞ্জাব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কারণেই বাঙালিরা সংসদে বেশি আসন পেয়েছিল, কিন্তু পাঞ্জাবিরা বিশ্বাস অর্জন করে যে শেখের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মতো একজন নেতা তারা পেয়েছে।

কিন্তু ভারতের ওপারে বঞ্চিত পূর্বাংশে বিক্ষুব্ধ বাঙালি নেতা এবং তার আওয়ামী লীগের সৈনিকেরা স্বায়ত্তশাসনের জন্য পেশকৃত ছয়-দফার এক ইঞ্চিও ছেড়ে না দেয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শেখ মুজিব এটা পরিস্কার করে বলেছেন যে, যখন তিনি স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেছিলেন তখন তিনি বিচ্ছিন্নতার কথা বলেননি। ‘আমি এই অর্থনৈতিক শোষণ যাতে চিরতরে শেষ হয় তার সাংবিধানিক নিশ্চয়তা চাই।’ আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী রয়েছে; সুতরাং সংখ্যাগরিষ্ঠরা সংখ্যালঘিষ্ঠদের সঙ্গে কীভাবে পৃথক হয়ে যেতে পারে’ — তিনি সেসময় আমাকে বলেছিলেন। সামরিক শাসনের দ্রুত প্রত্যাহারের দাবিতে অধিক ওজন দেয়ার জন্য তিনি ব্যাপকভাবে বেসামরিক অসহযোগ-আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সারা প্রদেশের সার্বিক জীবনযাত্রা ব্যহত হয় এবং বাংলাদেশের দাবি ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হতে থাকলে প্রেসিডেন্ট ১৬ মার্চ দু-টি বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে ঢাকায় উড়ে যান: (১) তিনি বলেন তিনি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে শিগগীরই ক্ষমতা ছেড়ে দিবেন যদি শেখ উভয় প্রদেশে প্রাদেশিক পর্যায়ে প্রাদেশিক জাতীয় সরকার গঠন করেন, অথবা (২) তিনি প্রদেশগুলোতে ক্ষমতা দিবেন এবং একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হবে যার প্রধান হবেন তিনি স্বয়ং এবং এই সরকার একটি সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত দেশের প্রতিদিনকার কাজ চালিয়ে নেবে।

সেসময় দুই নেতা বলেছিলেন আশার কথা এখনও আছে। কিন্তু মি. ভুট্টো ইতোমধ্যে প্রস্তাবগুলো শুনেছেন এবং জনসম্মুখে ঘোষণা করেন যদি কোয়ালিশন সরকারে পিপলস পার্টিকে অন্তর্ভুক্ত না করা হয় তবে পশ্চিম-পাকিস্তানে আগুন জ্বলবে। তার কথার প্রমাণস্বরূপ তিনি পাঞ্জাবে ব্যাপক সহিংস বিক্ষোভ করেন এবং ২১ মার্চ অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে আলাপ করার জন্য ঢাকায় চলে আসেন। যখন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবকে জিজ্ঞেস করেন কেন্দ্রীয় কোয়ালিশন সরকারে পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহত্তম দলের নেতা হিসেবে ভুট্টোকে নিতে প্রস্তুত আছেন কি না, শেখ তখন গণতান্ত্রিক রীতির কথা বলেন এবং জানান একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে সহযোগী হসেবে তিনি কাকে নেবেন না নেবেন তা পছন্দ করার অধিকার তাকে দিতে হবে। এখানেও বোঝা যাচ্ছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় বিষয়ে শেখের অংশগ্রহণের ইচ্ছা প্রমাণ করে তিনি বিচ্ছিন্ন হবার পরিকল্পনা করছিলেন না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট পুনরায় মি. ভুট্টোর জোর হুমকির কাছে নতি স্বীকার করেন এবং কোয়ালিশন সরকারের প্রস্তাব এভাবে বাতিল হয়ে যায়।

সময় পার হয়ে যাচ্ছে দেখে শেখ এবং ইয়াহিয়া দ্বিতীয় আপস-ফর্মুলায় রাজি হন: প্রাদেশিক পর্যায়ে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তর। শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে সামরিক শাসন তুলে নেবার জন্য জরুরি ভিত্তিতে আদেশ জারি করার জন্য এবং পূর্ব বাংলায় ও পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশে ক্ষমতা দেবার জন্য বলেন। শেখ মুজিব একটি সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত একটি প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রাষ্ট্র-পরিচালনার বিষয়টি মেনে নিতে রাজি ছিলেন। কিন্তু ইতোমধ্যে পাকিস্তানের ভাগ্য অন্যান্য শক্তি দ্বারা নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। মি. ভুট্টো সেনাবাহিনীর কট্টর জেনারেলদের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন এবং পূর্ব-বাংলার রাজপথের আন্দোলন মুজিবের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে।

সৈন্যরা ব্যারাকে যুদ্ধের পোশাক পরে ফেললে হতাশ ও বিক্ষুব্ধ বাঙালিরা ঢাকায় বাংলাদেশের পতাকা ওড়াতে শুরু করে। প্রেসিডেন্টকে পূর্ব-বাংলায় আগুন জ্বালাবার সিদ্ধান্ত নিতে ভুট্টোই বাধ্য করেন। মি. ভুট্টো প্রেসিডেন্টকে বোঝান সামরিক শাসন তুলে নিলে, প্রদেশে ক্ষমতা প্রদান করা মাত্র পাকিস্তান পাঁচটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে যাবে। তিনি আশংকা প্রকাশ করেন যে মুজিবুর রহমান কেন্দ্রীয় সরকারকে শেষ করে দিতে চায়। সামরিক শাসন তুলে নিলে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে থাকতে আর কোনো অবস্থা থাকবে না। অর্ধ-প্রভাবিত হয়ে প্রেসিডেন্ট আবার মুজিবের কাছে যান এবং আশংকাগুলো প্রকাশ করেন। তিনি মুজিবের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন জাতীয় সংসদ বসলে ও কেন্দ্রীয় সরকারকে এক ধরনের মূল্য দেয়া মাত্র তিনি সামরিক শাসন তুলে নেবেন। শেখ মুজিব দ্রুত সামরিক শাসন তুলে নেবার কথা পুনরায় দাবি করলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উপলব্ধি হয় যে তিনি একজন বিশ্বাসঘাতকের সঙ্গে কথা বলছেন এবং পুনরায় তার জেনারেলদের দলে চলে যান।

যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছতে চাইলে বলা যায়, বর্তমান হত্যাযজ্ঞের দায়-দায়িত্ব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ওপরই পড়ে, যখন তিনি বাঙালিদের সঙ্গে কোনোরকম আলোচনা ছাড়াই সংসদ বাতিল করে দেন, কিন্তু মার্চের ৩ তারিখে মি. ভুট্টো সংসদ বয়কট করলে তার ঘাড়ও অধিক দায়-দায়িত্ব গিয়ে পড়ে।

সূর্যের নিচে মৃতের সারি

নিউ স্টেটসম্যান, ৪ জুন, ১৯৭১

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

প্রথম আক্রমণের পর থেকে দুর্ভিক্ষ সবসময় যুদ্ধের একটি অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছে, এবং রোগবালাই দুর্ভিক্ষের কঠোর সহযাত্রী হিসেবে দেখা দিয়েছে। কিন্তু অতীতে যা ইতিহাসকে প্রকাশ করার জন্য রেখে দেয়া হয়েছিল তা এখন ঘটছে বলে পৃথিবীর সামনে উপস্থাপিত হচ্ছে। এখন আর কেউ দাবি করতে পারবে না যে পূর্ব বাংলায় কী ঘটছে তা সে জানে না। রঙিন টেলিভিশনে দেখা যাচ্ছে মৃতদেহগুলো সূর্যের আলোয় পচে যাচ্ছে। ছ-মাস আগে পৃথিবীর প্রতিক্রিয়া ছিল স্বয়ংক্রিয় এবং স্বাভাবিক। বন্যার পানি চারিদিকে বাড়তে থাকলে আশা-আকাঙ্ক্ষা, অকার্যকর হলেও, ধরে রাখা যায়। কিন্তু সেনাবাহিনী বন্যার পনি নয়। ছয় মাসের স্বল্প সময়ে চ্যারিটির রাজনীতি আরো অনেক জটিল হয়ে গেছে। জেনারেল ইয়াহিয়ার খানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কেবল উদাসীন ও উদ্দেশ্যপ্রবণ লোকজনই পশ্চিম পাকিস্তানকে নানা ধরনের সাহায্য করতে চাইবে। দু-সপ্তাহ ধরে জেনারেলের ঘনিষ্ঠতম উপদেষ্টা এম এম আহমেদ আমেরিকান সরকার ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের কাছে সুন্দরতম ভবিষ্যতের কথা শুনিয়ে অর্থসাহায্যের জন্য চাপপ্রয়োগ করছেন। তিনি তাদের বলছেন যে তার দেশ হলো অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত। গৃহযুদ্ধের কারণে প্রতিদিন ২০ লাখ ডলার নষ্ট হচ্ছে। যুদ্ধ রফতানি-মুদ্রার সঞ্চয়কে গিলে খাচ্ছে, যার বেশিরভাগই আসে পূর্বাংশ থেকে। এরকম হিসেব করা হয়েছে যে মি. আহমেদ এবং তার প্রভুর ৫০০ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন তাদের পশ্চিম-অংশকে রক্ষা করার জন্য। এখানে পূর্ব-অংশের কথা উল্লেখ করা হয় না যেখানে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগর কারণে দেশটি বিধ্বস্ত হয়েছে এবং তার আশু-পরিচর্যা প্রয়োজন।

স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া অনুসারে ইয়াহিয়াকে প্রয়োজনীয় অর্থসাহায্য দেয়াই যায়। পশ্চিমের সঙ্গে ইসলামাবাদ সরকারের সম্পর্ক ভালোই , আগের দু’জন সরকারই সামরিক বাহিনী থেকে আসার পরও। পুঁজিবাদী সরকারসমূহ সাধারণভাবে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষেই রয়েছে। সার্বভৌম দেশমূহের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না-করার জন্য বইতে আইন-কানুন লেখা রয়েছে, এবং তৃতীয় বিশ্বের আন্দোলনসমূহে এই আইন নিন্দাজনকভাবে ভঙ্গ করা হয়। আমরা মুখে স্বীকার করি কোনো পক্ষ অবলম্বন করে তাদের মনে আঘাত দেয়াটা অন্যায় হবে, কিন্তু আমরা আসলে হস্তক্ষেপ করি এবং ক্ষমতার পক্ষেই থাকি। যাহোক, এক্ষেত্রে সচারচরের কায়দা-কানুন ততটা খাটে নি যেমন মি. আহমেদ আশা করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে এব্যাপারে জনগণের অনুভূতি সরকারের পক্ষে যায় নি। এরকম ধারণা তাদের মধ্যে বদ্ধমূল হয়েছে যে এটা শুধু স্থানীয় একটি সমস্যা নয়, এখানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে। পশ্চিম-পাকিস্তান যতক্ষণ পর্যন্ত না একটা রাজনৈতিক সমাধান করতে পারছে, সিনেটের পক্ষে তাদের অর্থসাহায্য করা কঠিন হবে।

ইয়াহিয়ার জন্য সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আদায় শ্রদ্ধা পাবার একটি সার্টিফিকেট হবে। অনেক ধরনের ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে যে তিনি এটা অর্জনের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন। একটি হলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতাসহ বেসামরিক শাসনব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া। কিন্তু বিচ্ছিন্নতা শুরু হয়ে গেছে; ইউরোপীয়দের কাছে ব্যাপারটা রাজনৈতিক অর্থহীনতা লাগতে পারে। রক্ষণশীল হয়ে হিসেব করলেও শতকরা নব্বই ভাগ পূর্ব-পাকিস্তানী এখন বিচ্ছিন্নতাবাদী।

বিশ্বব্যাংকের একটি দল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশে আসবেন এবং এমাসের শেষে তারা ফিরে গিয়ে যে প্রতিবেদন জমা দেবেন তার ওপরে অনেক কিছু নির্ভর করছে। বর্তমান পাকিস্তান সরকার ইতোমধ্যে অন্তঃত যে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছে, তা দ্বারা পর্যবেকদের সন্তুষ্ট হওয়া-না-হওয়ার অনেক মূল্য থাকবে। সত্যি কথা বলতে ইয়াহিয়াকে কোনো অর্থ নগদ প্রদান করার অর্থ হবে যুদ্ধকে আরো দীর্ঘস্থায়ী করা। যদি খাদ্যের সরবরাহ করা হয় তবে, পূর্ব-বাঙালিরা মনে করে, এটা প্রথমে দেয়া হবে সেনাবাহিনীকে, এবং বাকি যা থাকবে তা দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হবে।

ব্রিটেনের জন্য সমস্যা হলো কায়েমী স্বার্থের রাজনীতির সঙ্গে মানবীয় প্রতিশ্রুতিকে কীভাবে সমন্বয় করা যায়। প্রাথমিক ধারণা অনুসারে যাদের সবচেয়ে বেশি দরকার তাদেরকেই খাদ্য ও চিকিৎসার সরবরাহ দেয়ার মাধ্যমে এই সমন্বয়-সাধন সম্ভব হতে পারে। এখানে দু-টো সুযোগ রয়েছে। প্রথমত, ত্রাণকার্য যেন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়, এব্যাপারে আমাদের জোর দিতে হবে। এক্ষেত্রে এমন নজির আছে যে পশ্চিম পাকিস্তানীরা এব্যাপারটায় বাধা প্রদান করবে। তবে এখানে সহজ একটা সমাধান আছে। উদ্বাস্তুশিবিরের পাঁচ বা ছয় মিলিয়ন লোককে খাওয়াতে ধনী দেশগুলো সরকারি অনুদান, জাতিসংঘ সংস্থাসমূহ ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসমূহের সাহায্য নিতে পারে। ভারত একাই সব সামাল দিতে পারবে না। আরেকটি সম্ভাবনাও আছে। সীমান্ত অঞ্চলে, আরেকবার বিশেষভাবে বলছি, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বাঙালি সরকারের সমর্থকদের মাধ্যমেও সরবরাহের কাজটি করা যেতে পারে।

সূর্যের নিচে শুয়ে থাকা মৃতদেহগুলো শিগগীরই বর্ষার পানিতে তলিয়ে যাবে। বর্তমানের কলেরা মহামারীর পূর্বে পাঁচ লাখ মানুষ ইতোমধ্যে মারা গিয়েছে। পশ্চিমা সাহায্য নিয়ে ইয়াহিয়া কয়েক মাস আরো বেশি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবেন যতক্ষণ না প্রথম শরতে প্রত্যাশিত দুর্ভিক্ষ চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছে। তিনি তার ৮০,০০০ সৈন্যের বাহিনীর জন্য নাছোড়বান্দার মতো সাহায্য চাচ্ছেন যারা এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছে এবং সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে পদানত রাখার জন্য। তিনি এদের নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন আইয়ূব খানের পদচ্যুতির পর থেকেই, যিনি ছদ্ম বেসামরিক প্রশাসন গঠনের জন্য ফিরে এসেছেন। যদি কিছু নাও হয় ‘বাঙালিদের শিক্ষা দেয়া গেছে’ মনে করে একধরনের আত্মতৃপ্তি পেয়েছেন। কিন্তু তাকে অনেক কিছু হারাতে হবে, সম্ভবত পশ্চিম পাকিস্তানকেই, যে দেশটিতে অনেক জাতি রয়েছে এবং বিভিন্ন উপাদান দিন দিন অস্থির হয়ে উঠেছে। এমনকি তার চীনা বন্ধুরাও তাকে সাহায্য করতে নাও পারে, স্যামসনের মতো, তার চারপাশেও মন্দিরের সব পিলার ধ্বংস হয়ে পড়বে।

ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রীরা কোনো কিছুতে সাম্রাজ্যবাদের গন্ধ থাকলে তা এড়িয়ে চলতে চায়, যা বোধগম্য কিন্ত বিপজ্জনক। কারো প্রকৃত প্রভাবকে অস্বীকার করে দায়িত্ব এড়ানো খুব সহজ। আমেরিকান বা আইএমএফ-এর সাহায্য-সরবরাহের সঙ্গে ব্রিটেনের সহায়তাকে খুব কমই তুলনা করা হয়। কিন্তু এরপরও ‘পাকিস্তান-জোটের’ ব্যাপারে আমাদের ভিন্ন মতামত রয়েছে। যদি আমরা ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্র এবং সৈন্যদের জন্য মাখন কেনা বন্ধ করি, ফ্রান্স, ইটালি, হ্যান্ড, কানাডা ও পশ্চিম জার্মানির মতো অন্যান্য দেশগুলোও আমাদের মতোই পদক্ষেপ নেবে। ভারতীয় উপমহাদেশকে তারা বিশেষ ব্রিটিশ-ভাবনায় গুরুত্ব দেবে।

ইয়াহিয়াকে সাহায্য দিতে অস্বীকার করা নৈতিক ও ব্যবহারিক দিক থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত হবে। তাকে যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য করা কেবল মানবীয় দুর্ভোগের ওপর সীমারোপই হবে না। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাবার সম্ভানাকে তা হ্রাস করবে, যে-যুদ্ধ হবে ভয়াবহ এবং আন্তর্জাতিক সমস্যা যা থেকে বেড়েই চলবে। যদি কোনো দেশ এখন ইয়াহিয়া খান ও তার অনুগত অনুসারীদের সাহায্য প্রদান করে তবে সে-দেশ গণহত্যায় অর্থ প্রদানের অভিযোগ এড়াতে পারবে না

ছবির কৃতজ্ঞতা: ম্যাগনাম ফটোস

বাঙালি বিদ্রোহীরা ঢাকায় নৃশংসতার প্রমাণাদি জাতিসংঘে পাঠাচ্ছেন

দি টাইমস, ২ জুন, ১৯৭১

পিটার হ্যজেলহার্স্ট

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

বাঙালিদের দাবিয়ে রাখার জন্য একটি সুপরিকল্পিতভাবে ভীতি-প্রদর্শনের জন্যই যে ২৬শে মার্চে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঢাকায় অপারশেন চালিয়েছিল, সেব্যাপরে এখন যথেষ্ট প্রমাণাদি পাওয়া যাচ্ছে। বিদ্রোহীদের দমন করতেই কেবল অপারেশনটি চালানো হয়েছিল, কারণ তারা সশস্ত্র-প্রতিরোধ করেছিল — পাকিস্তান-সরকার এই দাবিও তাতে বাতিল হয়ে যাচ্ছে। প্রমাণটি হল আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে সেনা-ইউনিটসমূহের মধ্যে যে বেতার-বার্তা বিনিময় হয়েছিল তার মুদ্রিত কপি। কপিটি এখন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের হাতে রয়েছে এবং তারা তা জাতিসংঘের মহাসচিব ও সব দেশের সরকার-প্রধানদের কাছে পাঠাবেন।

জেনারেল টিক্কা খান-এর কন্ট্রোল, সেনা-সরকার ও আর্মি ইউনিটসমূহের মধ্যে যে-বার্তা-বিনিময় হয়েছিল তার কিছু নমুনা এখানে দেয়া হল।

কন্ট্রোল: ওয়েল ডান। বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃতের সংখ্যা কত হবে বলে তুমি মনে করো?
৮৮: দাঁড়ান। আনুমানিক ৩০০। ওভার।
কন্ট্রোল: ওয়েল ডান। তিনশ মারা গেছে? কেউ আহত হয়েছে বা ধরা পড়েছে? সিটরেপ (সিচুয়েশন রিপোর্ট)। ওভার।
৮৮: আমি কেবল একটা জিনিসেই বিশ্বাস করি — ৩০০ মারা গেছে। ওভার।
কন্ট্রোল: হ্যাঁ, আমি তোমার সঙ্গে একমত। সেটাই হিসেব করা সহজ। কিছুই জিজ্ঞেস করা হয়নি, কিছুই করা হয়নি। তোমাকে কোনো কিছুর ব্যাখ্যা করতে হবে না। আবার বলছি, ওয়েল ডান। আমি আবার সব জওয়ানের উদ্দেশ্যে তোমাকে বলছি ‘সাবাশ’ …
৭৭: ৮৮ থেকে সর্বশেষ — তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সামনে আরো অনেক ভবন আছে যেগুলোকে একে একে ধ্বংস করতে হবে। তার কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয় নি, তবে তার বিরুদ্ধে গুলি ছোঁড়া হচ্ছে। তিনি যা পেয়েছেন তার সবই ব্যবহার করছেন। ওভার।
কন্ট্রোল: তাকে বলো যে, তার বড়ভাইরা (আর্টিলারি-সহায়তা) তাকে সমর্থন করার জন্য দ্রুতই আসছেন আশা করা যায় । সেগুলোকে ভবনগুলো ধ্বংস করার জন্য ব্যবহার করা যাবে। এখন অন্যদিকের কথা। আমার মনে হয় লিয়াকত ও ইকবাল (ছাত্রাবাস) এখন শান্ত …
কন্ট্রোল: বাংলাদেশী পতাকা না কালো পতাকা প্রসঙ্গে ইমামের (কমান্ডিং অফিসার) কাছ থেকে। ভবনের মালিকদের এখনই ঐসব পতাকা সরিয়ে ফেলতে হবে, নয়ত তাদের শাস্তি প্রদান করা হবে। কোনো স্থানে রাস্তা-অবরোধ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। এসব অমান্য করা হলে ঘটনাস্থলেই গুলি করে মারা হবে। বাড়ি ও ভবন এসব ক্ষেত্রে ধ্বংস করা হবে।
৮৮: উইলকো। আর কিছু? ওভার।
কন্ট্রোল: ইমাম এখন ইমাম ২৬-এর সঙ্গে রয়েছে। যদি তোমার কোনো ব্যাপারে কোনো সাহায্য প্রয়োজন হয় তুমি তাকে জানাতে পারো। বাক্সার (ধ্বংস করার স্কোয়াড) সম্পর্কে। তারা তাদের ঘাঁটি থেকে রওয়ানা দিয়েছেন এবং প্রথম আলো দেখা যাবার পরপরই তোমার সামনে পড়া যেকোনা অবরোধ সরাতে তোমাকে সাহায্য করতে পারবে। ওভার।
কন্ট্রোল: পিপলস ডেইলির (ডেইলি পিপল সংবাদপত্র) খবর কী? ওভার।
২৬: বোমা মেরে ধ্বংস করা হয়েছে। আবার বলছি, ধ্বংস করা হয়েছে। আমাদের দু-জন গুরুতর আহত হয়েছে ও সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
কন্ট্রোল: ওদিকে মৃতের আনুমানিক সংখ্যা কত? ওভার।
২৬: না। এই মুহূর্তে নির্ণয় করা কঠিন। স্থানে স্থানে আগুন জ্বলছে এবং সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়েছে।
কন্ট্রোল: পুলিশ লাইনে আক্রমণ করেছ? ওভার।
২৬: পুলিশ-লাইনেও আক্রমণ করা হয়েছে। ওভার।
কন্ট্রোল: গুড শো। আউট।

যুদ্ধ শুরু হয়েছে

দি টাইমস, ২ জুন, ১৯৭১

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

বাংলাদেশের নির্বাসিত নেতারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে শেষ-দেখে-নেয়া-যুদ্ধের কথা বলছেন

কলকাতা, ১ জুন। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার এবং বিধ্বস্ত দেশটির বামপন্থী বিরোধীদলসমূহ আজ পশ্চিম পাকিস্তানীদের সঙ্গে যেকোনো প্রকার সমঝোতার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রি এ. এম. কামরুজ্জামান এবং প্রধান বিরাধীদলীয় নেতা মাওলানা ভাসানী উভয়েই ইয়াহিয়া খানের সাধারণ মার সুযোগকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সংবাদপত্রসমূহকে দেয়া তথ্যবিবরণীতে তারা বলেছেন এটা হলো শেষ-দেখার-যুদ্ধ। কামরুজ্জামান বলেছেন, ২৫ মার্চের রাতে সেনাবাহিনীর হত্যালীলার পর প্রেসিডেন্টের কোনো কথাই পূর্ব-পাকিস্তানে আর বিশ্বাস করা হবে না। এই বাঙালি নেতার মতে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আগের দিনই প্রকৃত অর্থে বাঙালিদের দাবিকে মেনে নিয়েছিলেন এবং বেতারে তা ঘোষণার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

কামরুজ্জামান বলেন, ‘কিন্তু তা না-করে তিনি বাঙালি জাতিকে সমূলে উৎপাটনের জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশে আমাদের কাছে জেনারেল ইয়াহিয়া খান নামটি মানুষের পদবাচ্য কিছু মনে করা হয় না। নামটি একজন রক্তপিপাসু খুনী, একজন বিশ্বাসঘাতক এবং একজন পাকিস্তান-বিচ্ছিন্নকারীর প্রতীক হিসেবে পরিচিত। নিরীহ নাগরিক ও শিশুদের হত্যা করার পর আমাদের মেয়েদের ধর্ষণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের জন্য এক-পাকিস্তানের ছাদের নিচে থাকা সম্ভব নয়’। অতি-বাম বাঙালি-নেতা মাওলানা ভাসানী আজ সাংবাদিকেদের বলেন বামপন্থী বা ডানপন্থী কোনো বাঙালিই পশ্চিম-পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক সমঝোতায় যাবে না। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা ভাসানী পূর্ব-পাকিস্তানকে সহায়তা দানে ব্যর্থ হবার জন্য সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের সমালোচনা করেন।

কয়েক সপ্তাহের নিরবতার পর আজ আন্ডারগ্রাউন্ড-রেডিও-স্টেশন ”স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র” জানিয়েছে যে মুক্তিযোদ্ধা-গেরিলারা পশ্চিম-পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন স্থানে পরাজিত করেছে। ৫৫০-রও বেশি নিয়মিত সৈনিক নিহত হয়েছে এবং একটি গানবোটকে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে। বেতার-কেন্দ্র জানিয়েছে উত্তর-পূর্ব-অঞ্চল সিলেট স্বাধীন হয়েছে, তিনটি প্রধান রেলওয়ে-ব্রিজ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সৈন্যরা ব্যাপক চাপের মুখে রয়েছে।

দুর্ভাগ্যবশত, সহজ প্রতারণা ও সহজ উত্তেজনাসাধ্য বাঙালিদের নায়কোচিত যুদ্ধ এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে পিছু-হটানো ও পরাজিত করার কাহিনী হলো, সম্ভবত, আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনের মতোই — উর্বর-কল্পনাপ্রসূত সংবাদ। বাঙালিদের প্রত্যাশাকে ইচ্ছাপ্রণোদিতভাবে খাটো মনে না করেই আমি আজ সকালে একটি রেডিও-সিগনাল-এর দিক খোঁজার কয়েল দিয়ে ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে প্রচারিত হচ্ছে’ দাবি-করা রেডিও-স্টেশনটির দিক খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। আমাকে বিস্মিত করে দিক-খোঁজার কয়েলটি জানালো যে শক্তিশালী, স্পষ্ট বেতার-সম্প্রচারটি বাংলাদেশের দিক থেকে আসছিল না, আসছিল উত্তর দিক থেকে, যে-একই দিক থেকে অল-ইন্ডিয়া-রেডিও সম্প্রচারিত হচ্ছে। কলকাতা শহরের অন্যান্য স্থান থেকে ব্যাপারটি পরীক্ষা করা হলে বারবার উত্তর দিককেই খুঁজে পাওয়া গেল, যেদিকে চিনসুরা এবং মাগরা অবস্থান করছে এবং যেখান থেকে অল-ইন্ডিয়া-রেডিও সম্প্রচার করা হয়।

অবশ্য এখানে এটা বলা হচ্ছে না যে, মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ঘাঁটিসমূহে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে কোনো ধরনের আক্রমণ করছে না। তবে এটা বলা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার ব্যর্থ হয়েছে এবং প্রায় প্রতিটি সীমান্তে বাংলাদেশ-ধারণাকে বাঁচিয়ে রেখেছে ভারতীয় সরকার। প্রায় প্রত্যেক বাঙালি রাজনৈতিক নেতা ভারতে পালিয়ে গেছেন। মাওলানা ভাসানী সম্ভবত কলকাতায় নিরাপত্তা-হেফাজতে রয়েছেন, অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রি তাজউদ্দিন আহমেদ এবং তার পরিবারও ভারতীয় কোনো অঞ্চলে অবস্থান করছেন। আঁতুড়ঘরেই মৃত জাতীয় সংসদের সদস্যরা ব্যস্তসমস্তভাবে কলকাতা-দিল্লী করছেন। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন উপদেষ্টা, আইনজীবী, ডাক্তার ও শিকদের একটি দল এবং এতে কোনো সন্দেহ নেই যে পূর্ব-বাংলার ৭ কোটি অধিবাসী এখন নেতৃত্ববিহীন ও হতোদ্যম হয়ে পড়েছে।

এ-পরিস্থিতিতে, এতে কোনো সন্দেহ থাকে না বাংলাদেশ যদি স্বাধীনতা লাভ করে ও যখন স্বাধীনতা লাভ করবে, এর কার্যকর নেতৃত্ব পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল্স্-এর সাবেক অফিসারদের নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিবাহিনীর হাতে চলে যাবে। বর্তমানে ভারতীয় প্রশিকদের সহায়তায় মুক্তিবাহিনীর সিনিয়র অফিসাররা সীমান্তের ৩০টি ক্যাম্পে ৩০,০০০ আগ্রহী যোদ্ধাদের প্রশিণ দিচ্ছেন। একইসঙ্গে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় ভূখণ্ডে অবস্থিত ঘাঁটি থেকে ভারতীয় সেনা-বিশেষজ্ঞেদের পরামর্শক্রমে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের আঘাত করছে।

সব সীমান্তেই গেরিলারা সৈন্যদের বেশ ভালোভাবেই হেনস্থা করছে বলে ক্রমশ জানা যাচ্ছে। একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, তারা পশ্চিম-বাংলা, আসাম এবং ত্রিপুরার সীমান্তে অবস্থিত ছোট ছোট পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ক্যাম্পসমূহে ঝটিকা আঘাত করে ফিরে আসছে। তৎক্ষণাৎ বা পরবর্তী সময়ে যখন পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের গেরিলাদের সীমান্ত বরাবর তাড়া করছে, শেষ পর্যন্ত তাদের ভারতীয় সৈন্যদের মুখোমুখি হচ্ছে।

আমাদের দিল্লী-প্রতিনিধি জানাচ্ছেন: ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রি স্মরণ সিং আজ সংসদে বলেছেন, ভারত ব্রিটেনসহ বিভিন্ন বিদেশী সরকারদের চাপ প্রয়োগ করছে এই বলে যে পাকিস্তানের ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিকে পুনর্বাসিত করার জন্য যেকোনো সাহায্য ‘বাংলাদেশে বিরাজ-করা নিপীড়নমূলক পরিস্থিতিকে অস্বীকার করা হবে’। সদস্যরা যখন মি. সিংকে বাংলাদেশের প্রাদেশিক সরকারের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের মনোভঙ্গিকে অসম্মত করার জন্য জোরপ্রয়োগ করার উদ্যোগ নেন, তিনি কেবল ব্রিটিশদের কথাটিরই পুনরাবৃত্তি করেন: ‘দেশটির জাতীয় বিষয় নিয়ে নয়, কেবল সাহায্যের নীতিই এখানে নেয়া হয়েছে’।