Author Archives: Webmaster

ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনা: সংকট উত্তরণের আভাস

দি টাইমস, ২০ মার্চ, ১৯৭১

পিটার হ্যাজেলহার্স্ট

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

করচি, মার্চ ১৯। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান আজ ঢাকায় কয়েক দফায় আলোচনা শুরু করেছেন। দেশের সাংবিধানিক সংকটে তারা যে কট্টর অবস্থান নিয়েছিলেন, তা থেকে তারা কিছুটা নমনীয় হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে শেখের তিনজন উপদেষ্টা ড. কামাল হোসেন, মি. তাজউদ্দিন আহমদ ও মি. সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রেসিডেন্টর সহযোগীদের সঙ্গে আজ আলোচনায় বসবেন।

শেখ বলেছেন তিনি যখন আগামীকাল প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আবার আলোচনায় বসবেন তখন তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের ছয়জন সহযোগী থাকবেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মনে হয়েছে, মঙ্গলবার আলোচনা শুরু করার পর থেকে তাকে যেকেনো সময়ের চেয়ে সবচেয়ে বেশি শান্ত মনে হয়েছে। এদিকে করাচিত গত রাতে পিপলস্ পার্টির মি. জেড. এইচ. ভুট্টো সতর্ক করে দিয়েছেন যে, যদি ‘ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থ নিয়ে আপস করা হয়’ তবে তার দল পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্বের মতোই পশ্চিম পাকিস্তান অচল করে দেবে। এর আগে তিনি ঢাকায় প্রেসিডেন্ট ও শেখের সঙ্গে আলোচনায় বসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন তার দল পুরো পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার ‘রক্ষাকর্তা’ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থ ধুলিসাৎ করে এরকম কোনো সিদ্ধান্ত তিনি মেনে নেবেন না। তিনি বলেন, ‘যদি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সামর্থ্য পরীক্ষা নেয়া হয়ে থাকে, তবে এবার পশ্চিম পাকিস্তানের শক্তি প্রদর্শনের পালা’। প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, তিনটি প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট মুজিবুরের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। প্রস্তাব তিনটি থেকে মনে হচ্ছে কোনো প্রস্তাবই পূর্ব বা পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।

প্রথম প্রস্তাব অনুসারে উভয় অংশে প্রাদেশিক সরকারের হাতে মতা থাকবে এবং সেনাবাহিনী ততক্ষণ পর্যন্ত শাসন কার্যক্রম চালিয়ে যাবে যতক্ষণ না একটি সংবিধান প্রণীত হচ্ছে। শেখ এরকম কোনো অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান গ্রহণ করবেন না যাতে তার চূড়ান্ত স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থার কথা নেই। এই প্রস্তাবের বিকল্প হিসেবে ইয়াহিয়া উভয় অংশের নেতাদের কেন্দ্রে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করার পরামর্শ দিয়েছেন যা একটি সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত সামরিক সরকারের তদারকিতে চলবে।

স্বায়ত্তশাসনের বিতর্ক এড়ানোর জন্য প্রেসিডেন্ট বলেছেন সংবিধান গঠন না হওয়া পর্যন্ত কোনো প্রাদেশিক সরকারও গঠিত হতে পারবে না। প্রেসিডেন্ট দুই নেতাকে একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করতে বলেছেন, এবং তিনি উল্লেখ করেছেন, যদি তা করা হয় তবে প্রদেশে শিগগীরই মতা হস্তান্তর করা হবে। এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিত এটা মনে হবে যে নেতারা এই মুখ-রক্ষার ফর্মুলায় তারা লাফ দিয়ে অবতীর্ণ হবেন, কিন্তু সমস্যা হলো তারা প্রস্তাবগুলোকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করছেন।

শেখ উল্লেখ করেছেন তিনি প্রস্তাবটি গ্রহণ করতে পারেন তখনই যখন অন্যান্য পূর্বশর্ত মেনে নেয়া হবে। কিন্তু শেখ পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট দলগুলোর মধ্যে যারা তার দলের নীতিকে সমর্থন করেন তাদের নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করার অনুরোধ জানাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে মনে হচ্ছে। অন্যভাবে বলা যায় সেখানে ভুট্টো এবং তার পিপলস্ পার্টির কোনো স্থান থাকবে না (৩১৩টি আসনের মধ্যে তার ৮৪টি আসন রয়েছে)। এই ধরনের আয়োজনে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের বিরোধী দলে থাকতে হবে। শেখকে তখন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান ও সিন্ধুর আঞ্চলিক দলগুলোকে নিয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করতে হবে। এই ধরনের জোট-গঠন মি. ভুট্টো ও তার প্রদেশ পাঞ্জাবকে একাকী করে ফেলবে। এটা কোনো অবাক-করা কিছু নয় যে, মি. ভুট্টো এই প্রস্তাব মেনে নেন নি এবং উভয় অংশের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দল নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ওপরে তিনি জোরারোপ করছেন।

ইয়াহিয়া মেশিনগান-প্রহরায় ঢাকায় উপস্থিত হয়েছেন

দি গার্ডিয়ান, ১৬ মার্চ, ১৯৭১

মার্টিন এডনে

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

ঢাকা, মার্চ ১৫। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাংবিধানিক সংকট সমাধানের জন্য আজ মেশিনগানসহ অর্ধ ডজন সামরিক ট্রাক পেছনে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন। দুই সপ্তাহ ধরে এই সংকটের কারণে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান বস্তুত দুইটি পৃথক দেশ হিসেবে বিরাজ করছে। একজন মুখপাত্র জানান প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা করবেন যার দল আওয়ামী লীগ পহেলা মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সেবাখাত ও অফিস চলবে কি চলবে না, তার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।

তারা কয়েক প্লাটুন রাইফেলধারীর প্রহরাধীন প্রেসিডেন্ট-প্রাসাদে, নাকি দুই মাইল দূরবর্তী শেখ মুজিবের তিন তলার বাসভবনে আলোচনায় মিলিত হবেন তা এখনও নির্ধারিত হয় নি। শেখ মুজিবের এই বাসভবনে সাদা-পোশাক-পরা আওয়ামী লীগের কর্মীরা কোন সেবা চলবে এবং কোনটা চলবে না এসংক্রান্ত জরুরি প্রশ্নের উত্তর দেন। যদিও প্রেসিডেন্ট এবং শেখ মুজিব পরস্পর মিলিত হতে রাজি হয়েছেন কিন্তু বিষটি নিশ্চিত করা হয় নি। এই দুই বাসভবনের মধ্যবর্তী ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের তিনটি ফ্লোর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে — বলা হয়েছে ফ্লোরগুলো রঙ করার জন্যই এটা করা হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট এগুচ্ছেন স্বপ্রণোদিতভাবে। বিমান থেকে নামার পরে তিনি একটি কালো আমেরিকান গাড়িতে চড়ে ঢাকায় আসেন। তার আসার পথে প্রায় এক ব্যটেলিয়ান সৈন্য ব্রেনগানসহ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে। গাঢ় রঙের স্যুট পরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গাড়ির পেছন সিটে বসা ছিলেন, বিমানবন্দর ত্যাগ করার সময় তিনি হাত নেড়ে অভিবাদন জানান। কিন্তু প্রেসিডেন্ট-ভবনে প্রধান সামরকি আইন প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনা করার সময় তার হাতে ছিল না। কয়েক মিনিট পরে জেনারেল সাহেব রওয়ানা দেন।

প্রেসিডেন্টের আগমণে সপ্তাহখানেকের মধ্যে এটা পরিস্কার হয়ে যাবে কী সাংবিধানিক সমাধান হতে যাচ্ছে। ঢাকায় এক ধরনের স্বস্তি এসেছে এজন্য যে শেষ পর্যন্ত তিনি এলেন এবং অনেকে মনে করছিলেন বাংলার পরিস্থিতি আরও খারাপ হবার বিষয়টি তার অনুমোদনেই হচ্ছিল। বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের ওপরে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার মাধ্যমে গত সপ্তাহের শেষে অর্থনৈতিক অচলাবস্থা কিছুটা কাটলেও আজ নতুন করে কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে স্কুল, আদালত ও সরকারী অফিস বন্ধ থাকবে কিন্তু উপযোগী ও শিল্পসংক্রান্ত সংস্থাগুলো বিধিনিষেধের অধীনে চালু থাকবে।

সবাচাইতে দুঃশ্চিন্তার বিষয় হলো রফতানির অর্থ পূর্ব পাকিস্তানে আসছে না, ব্যাংকগুলো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নগদ অর্থ সংগ্রহ করতে পারছে না। ফলে রফতানি বন্ধ রয়েছে এবং দু’টি ব্যাংক ইতোমধ্যেই বিপদে পড়ে গেছে। একটি প্রচারণা-প্রত্যয় বাঙালিদের মধ্যে এভাবে কাজ করছে যে অনেক পশ্চিম পাকিস্তানী বিপুল অর্থ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করার চেষ্টা করছে। জনগণকে তাদের সম্পত্তি কিনতে বারণ করা হয়েছে। দুই সপ্তাহ আগের দাঙ্গা সাম্প্রদায়িক সংঘাতেও রূপ নেয় এবং এই বিষয়টি বারবার উল্লেখ করা বেসামরিক স্থিতিশীলতার জন্য কোনো শুভ প্রচেষ্টা নয়।

জঙ্গী ছাত্ররা আজ ঘোষণা দিয়েছে তারা আজ ‘বাংলাদেশ থেকে সম্পদ পাচার রোধ করা’-র জন্য চেকপোস্ট বসাবে। আজ দুপুরের পূর্বে বিমানবন্দরের একটি চেকপোস্টে একটি স্কুটারকে থামানো হয়। কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় একজন আরোহী একটি বন্দুক বের করে গুলি করে, একজন রিকশাচালক তাতে আহত হয় এবং আরোহী তার সহযোগীদের নিয়ে পালাতে উদ্যত হয়। তাকে ধাওয়া করা হয়, থামানো হয় এবং লাঠি ও ইটের সাহায্যে তাকে আঘাত করা হয়। এই গণপিটুনিতে ১,০০০ থেকে ২,০০০ জনের এক জনতাগোষ্ঠী অংশ নেয়। তাকে রক্তাক্ত ভূমিতে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে হয়। হাসপাতাল থেকে সরকারীভাবে জানানো হয় তারা দু-জন আহতকে ভর্তি করেছে। ঢাকা এই মুহূর্তে কতখানি উত্তপ্ত তার নিদর্শন হিসেবে এই ঘটনাকে ধরা যেতে পারে।

১০ দিন আগে দেয়া বেতার-ভাষণে ইয়াহিয়া যে প্রভুসুলভ মনোভাব প্রদর্শন করেছিলেন তা যদি এখনও বজায় রাখেন তবে সমাধান হবার সম্ভাবনা খুবই কম। আওয়ামী লীগের সদস্যরা বলাবলি করছে যে ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেই ফেলেছেন, কারণ সেখনে তিনি ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তি’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। বিগত কয়েক সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট যে-মনোভাব প্রদর্শন করেছেন তার চাইতে যথেষ্ট উদারতা, রাজনৈতিক সমঝোতা ও কৌশলের পরিচয় না দেখান এবং আজকের সেনামোতায়েনের বিপরীতে শেখ মুজিব যদি তার দলের চরমপন্থীদের শান্ত রাখতে না পারেন, তবে ঐতিহাসিক এক সংঘাত অনিবার্য হয়ে দেখা দিবে।

প্রান্তসীমায় টলমল

দি ইকোনমিস্ট, ১৩ মার্চ, ১৯৭১

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

এই সপ্তাহের শুরুতে ঢাকার পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হবার সঙ্গে সঙ্গে এখানে অবস্থিত প্রবাসী নাগরিকেরা তাদের ব্যাগ গোছানো শুরু করে দিয়েছে। ব্রিটিশ সরকারসহ অন্য অনেক দেশ তার দেশের নাগরিকদের অতি প্রয়োজন ছাড়া পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছে। অনেকে মনে করছেন সামরিক শাসন পুনঃপ্রয়োগের ফলে সৃষ্ট দাঙ্গা বোধহয় শেষ হলো। কিন্তু বিদেশীরা মনে করছেন এই শান্ত অবস্থা হয়তো পরিস্থিতি আরও খারাপ হবারই পূর্বলক্ষণ।

এটা সত্যি যে গত রোববারে (৭ মার্চ) শেখ মুজিবের পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার যে ‘ঐতিহাসিক ঘোষণা’ দেবার কথা ছিল তা তিনি দেন নি। ইয়াহিয়া খান রোববার কঠোরভাবে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন যে তিনি বা তার সেনাবাহিনী এরকম কোনো ঘোষণাকে সহ্য করবে না, সম্ভবত সেই সতর্কবাণী তাকে ওরকম ঘোষণা দেয়া থেকে বিরত রাখে। কিন্তু শেখ মুজিব এরপরই কাজের কাজটি করলেন। প্রেসিডেন্ট ২৫ মার্চে আইনসভার অধিবেশনের যে তারিখ ঘোষণা করেন, তার প্রত্যুত্তরে মুজিব জানান যে তিনি বা তার আওয়ামী লীগ অধিবেশনে যোগ দেবে না যদি না চারটি শর্ত মানা হয়। এরমধ্যে দু-টি শর্ত হলো যত দ্রুত সম্ভব সামরিক শাসন উঠিয়ে নিতে হবে এবং জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে — যে-শর্তগুলো প্রেসিডেন্টের মেনে নেয়া প্রায় অসম্ভব। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খুব শিগগীরই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবেন, এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এটাই হয়তো মুজিবের সঙ্গে তার শেষ আলোচনা।

পশ্চিম পাকিস্তানের মি. জুলফিকার আলি ভুট্টো অবশেষে কোনো রকম পূর্বশর্ত ছাড়াই যে ২৫ মার্চের অধিবেশনে বসতে রাজি হয়েছেন, এখন তার সামান্যই মূল্য রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসনের প্রভাব মুজিবকে একটি নতুন জমিনে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। এমনকি তিনি অপেক্ষাকৃত ধীরে ধীরে সামনে এগুচ্ছেন বলতে হবে, তার আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে যেসব চরমপন্থী লোক রয়েছেন তারা শনিবার রাতে স্বাধীনতা ঘোষণার পক্ষেই রায় দিয়েছিলেন। শেখ মুজিব আপাতভাবে আট ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন তাদের এটা বোঝাতে যে, প্রেসিডেন্ট নতুন তারিখের যে-প্রস্তাব দিয়েছেন তার তা গ্রহণ করা উচিত, কিন্তু তিনি অবশ্যই সেক্ষেত্রে শক্ত শর্ত দেবেন।

ঢাকার মতোই কিছু পদক্ষেপ অন্যান্য শহর থেকে এসেছে — কিন্তু এতে সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ দেবার কিছু নেই। তারা ঢাকা ও অন্যান্য শহর পরিচালনার দায়িত্ব একরকম মুজিবের হাতেই যেন ছেড়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের কর্মীরা ছয় দফার প্রতীক ছয়টি রূপালি তকমা-বিশিষ্ট সবুজ টুপি পরে ‘শান্তি রক্ষা’-র কাজ করছে যা পুলিশের চেয়েও ভালো কাজে দিচ্ছে। গত সপ্তাহে পাঁচ দিনের সর্বাত্মক ধর্মঘট মুজিবের জন্য বিরাট সাফল্য ছিল। রোববারে তিনি এ সপ্তাহের প্রতিরোধ-কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির মধ্যে আছে রাজস্ব প্রদান না করা, সরকারী অফিস-আদালত-স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখা এবং সব ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন করা। তিনি হুমকি দেন যে নতুন সর্বাত্মক ধর্মঘটের মাধ্যমে তিনি এই কর্মসূচিকে সম্প্রসারিত করবেন।

এখন পর্যন্তও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসনের কল্পব্যবস্থা বজায় রাখতে চান। যাত্রীপরিবাহী বিমানগুলোর মাধ্যমে তিনি ঢাকায় সৈন্যসংখ্যা বাড়িয়ে চলেছেন এবং ট্যাংকগুলোতে চাকা লাগিয়ে প্রস্তুত করা হচ্ছে রাজপথে লড়াই করার জন্য। কিন্তু জনগণ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যেভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তা থেকে এটা বোঝা কঠিন যে শেখ মুজিব কীভাবে অহিংস নীতি কার্যকর করবেন। প্রেসিডেন্টের জন্য বাস্তবানুগ ভাবনা এটা হতে পারে যে এই মুহূর্তেই শেখ মুজিবের সঙ্গে একটি রফা করে ফেলা, কারণ কেবল তিনিই স্বাধীনতার ঘোষণাকে আটকে রেখেছেন।

তাহলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কী মেনে নেবেন? আইনসভা অধিবেশনে যোগ দেবার ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের বেঁধে দেয়া চারটি শর্তের মধ্যে দু-টি সহজেই মেনে নেয়া যায়। সেগুলো হলো সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে আনা এবং গত সপ্তাহের হত্যাকাণ্ড নিয়ে তদন্ত করা। সেনাবাহিনী ব্যারাকে থেকেও এখন যে কাজ করছে তা চালিয়ে নিতে পারবে এবং তদন্তের ফলাফল হয়তো তাদের জন্য খুব খারাপ কিছু হবে না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো সরকারীভাবে সামরিক শাসন উঠিয়ে নেয়া এবং নির্বাচিত বেসামরিক প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। সামরিক শাসন পুরোপুরি ওঠানো সম্ভব নয় যতক্ষণ না তার বিকল্প কিছু দাঁড়াচ্ছে এবং যতক্ষণ না কোনো প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড়াচ্ছে, বেসামরিক সরকার ততক্ষণ পর্যন্ত প্রশাসন চালাতে পারবে না। কিন্তু এই কাজটা আইনসভা অধিবেশন না বসা পর্যন্ত প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। যত দ্রুত অধিবেশন বসবে তত দ্রুত এই কাজটা সমাধা করা যায়।

এর ফলে নতুন আইনসভা সার্বভৌম একটি প্রতিষ্ঠান হবে এবং নতুন সংবিধানে প্রেসিডেন্টের ভেটো দেবার মতা বিলোপ করবে; কিন্তু সেই ক্ষমতা ইতোমধ্যে অকার্যকর হয়ে পড়েছে কারণ শেখ মুজিব খুব সহজেই এমনকি সামরিক শাসনকে উপেক্ষা করতে পারেন। পূর্ব পাকিস্তানের ছয় দফা পরিকল্পনা তখন নতুন সংবিধানে প্রায় নিশ্চিতভাবেই লিখিত হবে। এই ধরনের শিথিল ফেডারেশন — যেমন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মনে করেন — পাকিস্তানের সমাপ্তি ঘটাবে; কিন্তু একমাত্র বাস্তবানুগ বিকল্প হলে পুরোপুরি বিচ্ছিন্নতা। যদি প্রেসিডেন্ট পূর্ব পাকিস্তানে বলপূর্বক দমনপ্রক্রিয়া চালান তবে তাতে সফল হবার সামান্যই সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তার জাতির উদ্দেশ্যে শনিবারে দেয়া ভাষণে তিনি সেই পথেই যাবেন বলে মনে হচ্ছে। তিনি যদি তা করেন তবে এই কমনওয়েলথভুক্ত দেশটিতে নতুন একটি গৃহযুদ্ধের সূচনা হবে যা বিশেষত ব্রিটেনের জন্য সমস্যাজনক হয়ে দেখা দেবে। পাকিস্তানের সঙ্গে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক অন্য খাতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

বায়াফ্রার যুদ্ধে ব্রিটেন নাইজেরিয়ার সরকারকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল যেগুলো বিচ্ছিন্নতবাদীদের নির্মূল করতে ব্যবহৃত হয়েছিল। পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধকে কেন ব্রিটেনের ভিন্নভাবে দেখা উচিত তার কারণ রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান এমন এলাকা যার সীমান্ত ইতোমধ্যে রয়েছে। বায়াফ্রার জন্য দাবিকৃত ভূখণ্ডে জেনারেল ওজুকুর যে-সমর্থন ছিল শেখ মুজিবের তার চাইতে অনেক বেশি সমর্থন রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের ৭০ মিলিয়ন বাঙালিরা কেবল পশ্চিম পাকিস্তানীদের থেকে সাংস্কৃতিকভাবেই আলাদা নয়, তারা কেবল আত্মসচেতন ও দৃঢ়চেতা জাতি হিসেবেই বিকাশ লাভ করে নি, পাকিস্তানের পুরো জনগোষ্ঠীর মধ্যে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কোনো ব্রিটিশ সরকারেরই উচিত হবে না, পাকিস্তানের সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধে অংশ নেয়া — আর ব্রিটেন পাকিস্তানের মূল অস্ত্রসরবরাহকারীও নয়।

মুজিব ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি

দি গার্ডিয়ান, ১৩ মার্চ, ১৯৭১

মার্টিন এডনে

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

ঢাকা, মার্চ ১২। শেখ মুজিব আজ ঘোষণা দিয়েছেন যে পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে একবার ও শেষবারের মতো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসতে ইচ্ছুক। যে-দলটি পূর্ব বাংলার সত্যিকারের সরকার হিসেবে কাজ করছে সেই আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব আমাকে বললেন: ‘আমি ব্যাপারটা সমাধা করতে আলোচনায় বসতে রাজি আছি। আমি যা বলেছি, পষ্ট করেই বলেছি। আমার নাগরিকেরা স্বাধীন নাগরিক হিসেবে একটি স্বাধীন দেশে বাস করতে চায়।’ ব্যাপারগুলো বিস্তারিতভাবে জানতে চাইলে, যেমন প্রতিরক্ষা বাজেটের ব্যাপারটা — যা আলোচনার একটি বিষয় হতে যাচ্ছে, তিনি বলেন: ‘দ্বিধাগ্রস্ত হবার আর কোনো সুযোগ নেই, আমি আমার জনগণের রক্তের বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না।’ তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হতে চান কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন: ‘তারা যদি আমাদের অংশ হিসেবে থাকতে বলে, তবে ভাইয়ের মতো একসঙ্গে থাকাই ভালো হবে।’

মুজিব বাঙালিদের ঐক্যের কথা জোর দিয়ে বলেন — যে-ঐক্য গত সপ্তাহজুড়ে প্রদর্শিত হয়েছে। তিনি দাবি করেন তাদের মগ্নতা ও নিয়মানুবর্তিতা দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে তাদের সাহায্য করবে। তিনি অভিযোগ করেন পূর্ব বাংলার সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে উপনিবেশের মতো ব্যবহার করা হয়েছে। সৌদি আরব ও চেকাস্লাভিকিয়া থেকে পাঠানো হেলিকপ্টার বাঙালিরা কখনো দেখে নি। বন্যা নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক সহায়তার সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ ‘রাতদিন কাজ করেছে এমনকি কোনো খাবার ছাড়াই’ এবং তিনি যদি বলেন তো ছাত্ররাও মাঠ পর্যায়ে যাবে। তিনি বলেন: ‘আমরা একটি নিয়মানুবর্তী জাতি; আপনি কি তা লক্ষ করেন নি?’

তিনি জোরারোপ করেন যে যদি রোববারের জনসভায় সেনাবাহিনী তাদের বিপে নামতো তবে জনগণ তা প্রতিহত করতে প্রস্তুত ছিল। ‘আমাদের জনগণ মৃত্যুকে বরণ করে নেবে। তারা প্রতিদিন ঘুর্ণিঝড়ে, বন্যায়, কলেরায়, অনাহারে মারা যায়। আমরা আরেক বার মরবো এবং সবার জন্য মরবো।’ পূর্ব পাকিস্তানের মর্যাদা যদি পরিবর্তিত হয় তবে তার পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি তার উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানান, তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বমতের গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি স্পষ্টতই সচেতন।

পাকিস্তানের অখণ্ডতা রায় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধাবস্থান নেয়া ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ছাপা হওয়া একটি প্রতিবেদনের উল্লেখযোগ্য অংশ এখানকার একটি পত্রিকায় গুরুত্বসহকারে ছাপা হয়েছে। এখানকার অর্থনীতি সংকটে পতিত হবার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ বাণিজ্যিক বিনিময়ের ওপরে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা খানিকটা শিথিল করেছে। দীর্ঘণ ব্যাংক খোলা রাখা অনুমোদন করা হয়েছে, অর্থ বিনিময় ও মাল খালাসের সীমা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পণ্য পরিবহণের অনুমতি দেয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীদের জন্য সপ্তাহে ১০,০০০ রুপি পর্যন্ত অর্থ গ্রহণের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বন্দর কর্তৃপকে সব ধরনের কাজ চালিয়ে যাবার জন্য বলা হয়েছে। শিল্পোন্নয়ন কর্পোরেশনের কারখানাগুলো চালু হয়েছে এবং কৃষিজ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কাজ চালিয়ে যাবার জন্য বলা হয়েছে।

রয়টার্স-এর সংযুক্তি: প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আজ মুজিবের সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকার পথে করাচিতে আসছেন। প্রেসিডেন্ট তার যাত্রা গোপন রেখেছেন। ওদিকে ঢাকার ১৭২ মাইল পশ্চিমে একটি জেলখানায় দাঙ্গা বেধে গেলে রীদের গুলিতে দু-জন বন্দি মারা গেছে এবং ২২ জন আহত হয়েছে। লোহার রড ও অন্য অস্ত্রের আঘাতে ৩০ জন পুলিশও আহত হয়েছে। গতকাল রাতে বরিশাল জেলে ২০০ জন বন্দি রীদের ওপরে চড়াও হলে দাঙ্গা বেধে যায়। পুলিশ বলেছে বন্দিদের জেলখানার মূল গেট ভেঙ্গে ফেলার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু তাদের মধ্য থেকে ২২ জন জেলখানার উঁচু দেয়াল অতিক্রম করে পালিয়েছে। বর্তমান আন্দোলন চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানের জেলখানা থেকে প্রায় ৩৮৫ জন বন্দি পালিয়েছে।

বিভক্ত পাকিস্তান

নিউ স্টেটসম্যান, ১২ মার্চ, ১৯৭১

ফ্রান্সিস হোপ

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

যখন একটি রাজনৈতিক বোমা ফাটে, তখন বিশ্ব অবাক হয়ে ভাবে কেন শান্তি এতো দীর্ঘ সময় ধরে বিরাজ করছিল? উত্তর আয়ারল্যান্ডের মতো পূর্ব পাকিস্তানে অনেক বছর ধরে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। কিন্তু এটা ছিল শান্ত অস্থিতিশীলতা। এখন এটা বিস্ময়কর মনে হয়, এমনকি অলৌকিক মনে হয়, যে তারা কখনও স্বাধীনতার দাবি স্থগিত রেখেছিল।

এটা বোঝা যাচ্ছে যে ঢাকার শেখ মুজিবুর রহমান ও ইসলামাবাদের ইয়াহিয়া খানের মধ্যে একটা আপসরফা হতে যাচ্ছে এবং এখানে জুলফিকার আলি ভুট্টো আশ্চর্য নিরবতা পালন করছেন। এটা খুবই সম্ভব যে পূর্ব পাকিস্তান সর্বোচ্চ অর্জনের জন্য চেষ্টা চালাবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবে; আর এক বা দু-বছরের মাথায় তারা কুর্দিস্তান বা বায়াফ্রার মতো বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবে। কিন্তু বিগত ২০ বছর ধরে বিশ্ব যেটাকে এড়িয়ে গেছে, দুই অংশের মধ্যে যে বিরাট পার্থক্য, তাকে আর এড়ানো সম্ভব নয়। দুই অংশের মধ্যে হাজার মাইলের যে-ভৌগোলিক ব্যবধান, তা এই ব্যবধানের ন্যূনতম অংশ।

পাকিস্তান নামটিও পূর্ব অংশকে বাদ দিয়েই গঠিত হয়েছে। এখানে P অর্থ পাঞ্জাব, A অর্থ আফগান, K অর্থ কাশ্মির এবং S অর্থ সিন্ধু। লর্ড কার্জনের বিখ্যাত বঙ্গভঙ্গের সময়ে তাকে আলাদা করা হয়েছিল কিন্তু দেশভাগের সময়ে তাকে ভারত থেকে বের করে দেয়া হয়। তারা পাকিস্তানের ১২ কোটি জনগোষ্ঠীর অর্ধেকরও বেশি, কিন্তু তারা বাস করে দেশটির ছয় ভাগের এক ভাগ অংশে। এটা সমৃদ্ধ কিন্তু অরক্ষিত ভূমি, গত বছরের বন্যা নাটকীয়ভাবে তা দেখিয়ে দিয়েছে: বাংলার মুঘল শাসকরা একে বলেছিলেন ‘খাদ্যে ভরপুর নরক’ হিসেবে। এই অংশটি রাষ্ট্রের কাছ থেকে মোট রাজস্বের এক চতুর্থাংশের এবং উন্নয়ন বাজেটের এক তৃতীয়াংশেরও কম পেয়ে থাকে; আর সব পণ্যের এক চতুর্থাংশ এবং বৈদেশিক সাহায্যের এক পঞ্চমাংশ পেয়ে থাকে। শেষের দুই বরাদ্দ পরিহাস বিশেষ, কারণ বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় পুরোটাই আসে পূর্ব পাকিস্তানের পাট থেকে।

অবশ্যই একটি অপেক্ষাকৃত দরিদ্র এলাকা সাধারণত দেয় কম, তাই পায়ও কম। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে দ্রব্যমূল্যের দাম বেশি। চালের দাম পশ্চিমের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। আর চাকরি দেয়া হয় খুবই কৃপণ কায়দায়। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরির মাত্র ১৫ ভাগ এবং সেনাবাহিনীর চাকরির ১০ ভাগ মাত্র পূর্ব পাকিস্তানীদের দখলে আছে।

ঢাকা থেকে এটা মনে হতেই পারে যে বাংলার মানুষ হলো শোষিত প্রলেতারিয়েত জনগোষ্ঠী, আর অন্যদিকে করাচিতে সামরিক লোকজন অনাবশ্যক বিলাসিতায় ডুবে রয়েছে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানীদের আপত্তি নেই, কিন্তু কাশ্মিরকে পুনর্দখল করার জন্য চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে তারা পশ্চিম পাকিস্তানীদের মতো অতটা আগ্রহী নয়। কাশ্মির তাদের সমস্যা নয় এবং তারা বুঝতে পারে না কেন এজন্য তাদের কেন্দ্রে পয়সা দিতে হবে। আঞ্চলিক ক্ষোভ আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। গত বছরের নির্বাচন পূর্ব পাকিস্তানকে ক্ষোভ প্রকাশের একটি সুযোগ করে দেয়, আর পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সেটা ছিল কেবল মত প্রকাশের সুযোগ। পশ্চিম পাকিস্তানের ১৩৭টি আসনের মধ্যে ভুট্টোর পিপলস্ পার্টি কেবল ৮৩টি আসন পায়, এবং পূর্বে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ ১৫৩টি আসনের মধ্যে ১৫১টি আসন লাভ করে। কিন্তু এই দুটি জয় তুলনা করার মতো কিছু নয়। ব্রিটিশ রানি ইংরেজ সমাজতন্ত্রী বা স্কটিশ জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে কাকে সংসদে পাঠাবেন, যেক্ষেত্রে স্কটিশরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে?

নানা ধরনের সুবিধার কারণে ভুট্টো একটি ঐক্যবদ্ধ দলের নেতা, যে-দলের পুরো দেশের জন্য কর্মসূচি রয়েছে। শেখ মুজিবও মোটামুটিভাবে তাই। তার সাফল্য আদর্শগত কারণে দ্রুত এসেছে এবং তাকে বামপন্থীদের পাশ কাটাতে হয়েছে, অতিক্রম করে যেতে হয়েছে। বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর অনেকের কাছে তার ছয় দফা এখনও একটি অশুভ বিষয়। সামান্য সম্ভাবনা দেখেও ভুট্টো এবিষয়ে ঝুঁকি নেন এবং ঘোষণা দেন ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের ব্যাপারে আগাম নিশ্চয়তা না দিলে তিনি আইনসভার অধিবেশনে যোগ দেবেন না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর কাছে সমর্পিত হন এবং অধিবেশন স্থগিত করেন। শেখ মুজিব এর প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেন: গান্ধীবাদী এই অহিংস কৌশল ইয়াহিয়া খানকে বাধ্য করে ২৫ মার্চে অধিবেশনের তারিখ ঘোষণা করতে; আইয়ুব খানের সত্যিকারের ক্ষমতা নেবার দিন সেটা। কিন্তু এবার শেখ মুজিবের না বলার পালা। তিনি সামরিক শাসন তুলে নেয়া ও গত সপ্তাহের হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া পর্যন্ত অধিবেশনে বসতে অস্বীকৃতি জানান। এখন আর চুপ করে বসে থাকার সময় নয়। দেশের দুই নির্বাচিত নেতার জনগণের কাছ থেকে পাওয়া পৃথক ধরনের রায়কে একত্রে সংবদ্ধ করা কঠিন, কিন্তু এবার তারা পরিস্কারভাবে কিছু একটা লাভের জন্য অবস্থান নিয়েছেন।

এই মুহূর্তে শেখ মুজিবই হলেন বাড়ির প্রকৃত মালিক। গত সপ্তাহ ছিল তার অহিংস পদ্ধতি ও সত্যিকারের ক্ষমতা প্রদর্শনের কাল। তার নির্দেশ অনুসারে ঢাকা একটি অচল শহরে পরিণত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের প্রতীক হলো নৌকা এবং প্রতিটি বাড়িই কাঠের নৌকা প্রদর্শন করছিল, কিন্তু পরিস্থিতি কাঠের নৌকার সমাবেশের চাইতে বেশি কিছু ছিল। পূর্ব পাকিস্তানী সৈন্য ও পুলিশ আপাতভাবে ইতোমধ্যেই শেখ মুজিবের কাছ থেকে নির্দেশ নিয়ে বসে আছে। সামরিক গভর্নরের বাসার কর্মচারীরা প্রায়ই কাজে ফাঁকি দিচ্ছে এবং সামরিক রীদের রান্না করা খাবার খেয়ে তাকে দিন চালাতে হচ্ছে। ঢাকা বেতার ‘পাকিস্তান বেতারের ঢাকা কেন্দ্র’ নাম পাল্টে ‘ঢাকা সংবাদ কেন্দ্র’ নাম ধারণ করেছে এবং যে-সব কাগজ কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে সংবাদ পরিবেশন করে শেখ সেসব কাগজে কাজ করা থেকে বাঙালিদের বিরত থাকতে বলেছেন।

চলতি তথ্যযুদ্ধ ভয়াবহ, আম্মানের স্মৃতিবহ। গত সপ্তাহের দাঙ্গায় পাকিস্তানের সরকারী সৈন্যরা বেশ কিছু আন্দোলনকারীকে হত্যা করে। পশ্চিম পাকিস্তান নিহতের সংখ্যা ১৭১ স্বীকার করেছে, পূর্ব পাকিস্তান দাবি করছে ৫০০ জন্য মারা গিয়েছে। এছাড়া এই সপ্তাহের প্রথম অর্ধে পশ্চিম পাকিস্তান উচ্ছৃঙ্খল-ছাত্রের-ওপর-রাগান্বিত স্কুলশিক্ষকের মতো ক্রুদ্ধ নিরবতা পালন করছে। অন্য কোনো পন্থায় না গিয়ে ইয়াহিয়া খানই শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে আসতে চেয়েছেন। কাশ্মির থেকে লাহোরে একটি বিমান ছিনতাই করে নিয়ে গেলে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বিবাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ভারতের নিষেধাজ্ঞার কারণে পাকিস্তানের যেকোনো বিমানকে ভারত ঘুরে শিলং হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করতে হচ্ছে, তা সেটা প্রেসিডেন্টকে বহনকারী হোক বা সংখ্যাবৃদ্ধির জন্য সৈন্যপরিবহণকারী হোক। পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাবৃদ্ধির প্রক্রিয়া সমস্যার মুখোমুখি পড়েছে।

আর ইয়াহিয়া খানকে এখন পূর্ব পাকিস্তানের ছয়দফার চাইতে বেশি কিছূ বিবেচনায় আনতে হবে। সাম্প্রতিক খবরে জানা যায় নতুন ফেডারেল সংবিধানের জন্য আওয়ামী লীগ ৪১ দফার একটি খসড়া করেছেন। এই খসড়া অনুসারে ‘পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্র’ পাঁচটি এলাকায় বিভক্ত হবে: বাংলা, সিন্ধু, পাঞ্জাব, পাখতুনিস্তান ও বেলুচিস্তান। প্রতিটি রাষ্ট্র তার নিজস্ব কৃষি, শিল্প, ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স, স্টিল মিল ও যোগাযোগ-ব্যবস্থাসহ নিজেদের মিলিশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করবে। উর্দু ও বাংলা সমভাবে সরকারী ভাষা হবে। পৃথক মুদ্রার পূর্বপ্রস্তাব বাদ দেয়া হয়েছে কিন্তু প্রতিটি রাষ্ট্রের নিজস্ব রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে ও পৃথক বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে মুদ্রা, পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত ক্ষমতা থাকবে। এখানেও কিছু পার্থক্য দেখা যাবে; নৌবাহিনীর সদর দফতর হবে বাংলায়, সেনাবাহিনীর সদর দফতর হবে পাঞ্জাবে এবং সিন্ধুতে থাকবে বিমানবাহিনীর সদর দফতর। প্রতিটি ক্ষেত্রে আবার নিজস্ব বাহিনী থাকবে।

এই কর্মসূচি অনেকটা ব্রিটেনের অর্থনৈতিক নীতির মতো হতে পারে: অনেক বেশি এবং অনেক বিলম্ব। এটা বর্তমান সামরিক শাসকদের জন্য অনেক বেশি। আর এটা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য অনেক বিলম্বের একটি প্রস্তাব। কারণ তারা ইতোমধ্যে দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আদেশ অমান্য করার ক্ষেত্রে দিন দিন তারা নিজস্ব আস্থা অর্জন করে চলেছে। অধিবেশন স্থগিতের পর প্রতিটি দিনই তাদের প্রত্যাশা বেড়ে চলেছে। শেখ মুজিবের রক্তপাত এড়ানোর জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা কিংবা ইয়াহিয়া খানের বেসামরিক প্রশাসনের হাতে অবিভক্ত পাকিস্তানকে ফিরিয়ে দেয়ার আন্তরিক আকাক্সা দেখে বলা যায় নেতৃবৃন্দ প্রশংসাযোগ্য কাজই করছেন। অনেকে হয়তো পূর্ব পাকিস্তানকে প্রতিবেশীদের সাহায্য নিয়ে পরিণত হওয়া অসমর্থ রাষ্ট্র হিসেবেও মেনে নেবেন (যদিও এধরনের দুর্ভাগ্য কে-বা বরণ করতে চায়?) এবং বহু বছরের অবহেলার ফল নতুন সরকার কাটিয়ে উঠবে। কিন্তু সময় আন্তরিকতাকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। এটা এই মুহূর্তে দেখা খুব কঠিন যে কীভাবে উভয় প অনড় অবস্থান থেকে সরে আসে এবং কীভাবে অধিক সহিংসতা এড়ানো যাবে। এর একটিও যদি না করা যায় তবে ঢাকায় মৃতের সংখ্যা আগামী সপ্তাহে আরও বেড়ে যাবে।

কলকাতা থেকে।

পূর্ব পাকিস্তান ক্ষমতা দেখাচ্ছে

দি গার্ডিয়ান, ১২ মার্চ, ১৯৭১

মার্টিন এডনে

ঢাকা, মার্চ ১১। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি চরম সংকটের মুখে পড়েছে। কারণ আওয়ামী লীগের শেখ মুজিবুর রহমানই এখন প্রদেশটির সরকারের মতো কাজ চালাচ্ছেন এবং তার নির্দেশ মতো স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বন্ধ রয়েছে। যদিও অর্থ উত্তোলনের ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধ আছে — ব্যবসায়ীরা এক মাসে ১,০০০ টাকা ও চাকুরীজীবিরা ১,৫০০ টাকার বেশি তুলতে পারবে না — কিন্তু ব্যাংকগুলো এই চাহিদাটুকুও পূরণ করতে পারছে না, এমনকি তারা একে অপরের চেককেও বিশ্বাস করছে না। পাটকলগুলো আগামী রোববারে পাট কিনতে ও মাসিক বেতন-প্রদান করতে পারেব কিনা তা নিয়েও তারা চিন্তিত। আওয়ামী লীগ গর্ব করে বলছে রফতানি বন্ধ আছে কারণ জাহাজের মালিকরা শুল্ক ধর্মঘটে যোগ দেয় নি।

রোববারে মুজিবের বক্তৃতার পর যে অনুপ্রেরণা কাজ করছিল, প্রেসিডেন্টের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হয় তা দেখতে যে-উদ্বিগ্ন প্রতীক্ষা শুরু হয়েছে তা অনুপ্রেরণাকে দূর করে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট পূর্ব পাকিস্তানে কবে আসবেন তা অনিশ্চিত, কিন্তু গুজব শোনা যাচ্ছে যে তিনি আজ রাতেই আসছেন।

দ্রব্যমূল্যের দামের ঊর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছে — চালের দাম বেড়েছে শতকরা ২০ ভাগ এবং রান্নার তেলের দাম বেড়েছে শতকরা ৫০ ভাগ। অনেক লোকই ঢাকা ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে গিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। এরকম একটি কথাও অনেকে ভাবছেন যে বর্তমানের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতে পারে না। কেউ কেউ বলছেন এসব করে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থই পূরণ করা হচ্ছে। কেবল ব্যবসায়ীরা নয়, অনেক লোকই এখন ভাবছে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হওয়া খুব বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে কিনা। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত পাঁচ লক্ষ বাঙালির সঙ্গে কোনো প্রকার যোগাযোগ নেই।

এরকম কোনো ধারণা দেয়া মুশকিল যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এই প্রদেশটি নিজেকে কতটা স্বাধীন ভাবে যার সঙ্গে কোনো ধরনের ডাক, টেলিফোন বা টেলিগ্রামে যোগাযোগ নেই। একটা রিকশায় করে আমি একটি পানির গাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। গাড়িটির পেছনে ছয় জন লোক ঝুলছিল। তারা বলে উঠলো: “জয় বাংলা”। আমার রিকশাচালক মাথা ঘুরিয়ে বললো: “স্বাধীন বাংলা”। আমি জিজ্ঞেস করলাম এই দু-টি চিৎকারের মধ্যে পার্থক্য কী? রিকশাওয়ালাটা বললো, “কোনো পার্থক্য নেই”।

এখানকার সব বিচারপতি একটি নতুন গভর্নরের অধীনে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এ-হলো বাঙালি ঐক্যের আরেক সাক্ষ্য যার মধ্যে ব্যবসায়ী গর্ব এবং হাওয়ার কাছে সমর্পণের বিচক্ষণতা। এই চেতনার স্রোত সৃষ্টি হয়েছে মুজিবের আহ্বান থেকে। আবার মুজিবেরও কোনো উপায় নেই, তাই তাকে এই চেতনা বহন করতে হচ্ছে। এটা মনে হচ্ছে যে ইয়াহিয়া আসছেন শেখকে কিছু ছাড় দিতে, কিন্তু কোন পর্যন্ত তিনি তা দিতে পারেন তার নানা দিক রয়েছে। এটা পরিস্কার যে মুজিব যদি তার অনুসারীদের সঙ্গে রাখতে চান তবে তাকে অন্তঃত আওয়ামী লীগের ছয় দফা অনুসারে দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে এবং রাজস্ব ও বৈদেশিক বাণিজ্য হাতে রাখতে হবে।

কিন্তু এটা খুবই সন্দেহজনক সেনাবাহিনী এটা মেনে নিবে কিনা। কারণ জাতীয় বাজেটের অর্ধেকেরও বেশি তারা প্রতি বছর নিয়ে থাকে। শেখের সমর্থকরা এটা দাবি করছেন যে ইয়াহিয়া প্রদেশের মতা আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিবের কাছে হস্তান্তর করবেন, কিন্তু এটা একটা আশাবাদী ধারণা মাত্র। এটা জানা কঠিন যে মুজিব কী ধরনের স্বায়ত্তশাসন রফা করবেন, যিনি এখন পর্যন্ত বিশ্বাস করেন স্বাধীনতার সামান্য কম স্বায়ত্তশাসন পেলে থেমে যাওয়া যায়। হয়তো দুই প্রধানমন্ত্রির কনফেডারেশনকে তিনি মেনে নেবেন। ইতোমধ্যে সেনাবাহিনী ঢাকা বিমানবন্দরের কাছাকাছি অপেক্ষা করছে। তারা বিশ্বাস করে আদেশ দেয়া হলে তারা দ্রুতই প্রদেশটিকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে, যদিও বাঙালিরা দূরবর্তী যোগাযোগ-ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটিয়ে চলেছে। অবশ্য তারা এটাও জানে যে এই সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক ফলাফল কত ভয়াবহ হতে পারে।

এখানে দুই ডিভিশন সৈন্য আছে বলে জানা যায় যাদের মধ্যে কিছু আছে বাঙালি। এছাড়া আছে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস্, যারা স্থায়ী সীমান্তরাকারী বাহিনী। তাদের সংখ্যা ২০,০০০-এর কিছু বেশি যারা সেনা ঘাঁটি থেকে দূরে এখানে রয়েছে এবং তাদের হাতে রাইফেলের চাইতে সামান্য শক্তিশালী অস্ত্র রয়েছে। অভিযান শুরু হলে তাদের আনুগত্য বিভক্ত হয়ে পড়তে পারে। আবার এরকম গুজবও শোনা যাচ্ছে বিমানযোগে আরও সৈন্য আসছে এবং নৌজাহাজে আরও সৈন্য রওয়ানা দিয়েছে। সেনাবাহিনীর ওপর কঠোর নির্দেশ আছে যাতে কোনো ধরনের ঘটনাকে তারা উস্কে না দেয় গত রাতে এখান থেকে উত্তরে কিছু সরবরাহের জন্য যাওয়া চারটি গাড়ির একটি কনভয় জনতার বাধার মুখে পড়লে গুলিবর্ষণ ছাড়াই তার ফিরে যায়। কিন্তু সাধারণভাবে সেনাবাহিনী সাধারণ ঠিকাদারদের মাধ্যমেই বিভিন্ন সরবরাহ পাচ্ছে যদিও চরমপন্থী নেতারা তা প্রতিরোধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

এখানে আরও একটি কথা হচ্ছে যে, প্রেসিডেন্ট যদি কঠোর পদক্ষেপ নেন তবে তার ফল কী হবে। এর অর্থ পাল্টা উদ্যোগ মুজিবের দিক থেকে না এসে অন্য দিক থেকেও আসতে পারে। কট্টরপন্থীদের কাছে মুজিব কোনো বিপ্লবী নন এবং তার রাজনৈতিক দর্শনও যথেষ্ট অস্পষ্ট। কিছু তথাকথিত গেরিলা-গোষ্ঠী আছে যারা গত কয়েক মাসে গ্রামাঞ্চলে কিছু রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যা করেছে এবং এরকম একটি ভয় আছে যে পশ্চিমবঙ্গের মতো এখানেও নকশাল আন্দোলন ছড়িয়ে যেতে পারে — বিশেষত মুজিবকে যদি দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। বাঙালিদের সাহসিকতার কথা শোনা গেলেও বৃহদাকারে সংগঠিত কোনো প্রতিরোধের পরিকল্পনার নিদর্শন দেখা যায় নি।

গত কয়েক সপ্তাহ জুড়ে যে প্রবল বাঙালি জাতীয়তাবাদ দেখা দিয়েছে যদিও তার ভবিষ্যত ঘোলাটে বলেই মনে হচ্ছে। যদি এই জাতীয়তাবাদ নিজেকে পরিচালিত করতে পারে তবে এই পশ্চাদপদ ও হতাশ প্রদেশটির জন্য তা মূল্যবান সম্পদই হবে। অবশ্য তারা সবসময়ই বলার জন্য প্রস্তুত থাকে যে তাদের এই পশ্চাদপদতার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান দায়ী। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা সম্ভবত আট কোটি এবং আশংকা করা হচ্ছে কার্যকর জন্মনিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা চালু করা না গেলে এই সংখ্যা আগামী ২৩ বছরে দ্বিগুণ হবে। নতুন কোনো ভূমি নেই চাষ করার জন্য। এমনকি গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের মাঝামাঝি অঞ্চলের কর্দমাক্ত ভূমিতেও ধানচাষ করা হয় এবং শহর দ্রুত সেদিকে ধাবিত হচ্ছে। একমাত্র আশা হলো ইতোমধ্যে উন্নত বীজ উদ্ভাবিত হয়েছে, অধিক সার ব্যবহার করা হয়েছে ও অধিক সারের অর্ডার দেয়া হয়েছে এবং সেচব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।

এখানকার প্রধান রফতানি-পণ্য হলো পাট এবং সিন্থেটিক ফাইবারের আবির্ভাবে তা হুমকির মুখে পড়েছে। ব্যাপক প্রনোদনা সত্ত্বেও শিল্প বিঘ্নিত হয়েছে ও বিনিয়োগ বিফলে গেছে। কেউ নিন্দুকের মতো বলতেই পারেন পূর্বকে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে পশ্চিম খুব কৃপণ হতে পারে, কিন্তু পৃথিবীর সবচাইতে জনবহুল এই জনগোষ্ঠীর দুর্দশার খানিক উন্নতি ঘটাতে চাইলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পুরো সঞ্চয় ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন হবে।

টুকরো হয়ে যাবার আশংকা, পাকিস্তানের স্বপ্ন ছিন্নভিন্ন

দি টাইমস, ১০ মার্চ, ১৯৭১

জেড. এইচ. জাইদি

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

পাকিস্তানের দু-অংশের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা কি অবশ্যম্ভাবী? আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস্ পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলি ভুট্টোর মধ্যে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা দেখে অনেক পর্যালোচকের মনেই এখন এই প্রশ্ন। ভুট্টোর আইনসভার অধিবেশন বয়কটের অবিচণ হুমকি, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা পূর্বে তৎপরবর্তী বিক্ষোভ-আন্দোলনের ফলেই এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। দুই দলের মধ্যে রাজনৈতিক বৈরিতা এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বঞ্চনা থেকে পূর্ব পাকিস্তানীদের মধ্যে সৃষ্ট অসন্তোষ থেকেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

দুই অংশের বৈরিতা নতুন কিছু নয়। দেশভাগের পর থেকেই বাঙালি মুসলিম জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি। ভাষা থেকে তারা এর শক্তি পেয়েছে। ১৯৫০-এর দশকে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চাইলে তা প্রতিরোধে যারা আত্মত্যাগ করেন তাদের স্মরণ এই জাতীয়তাবাদের শক্তির উৎস। শেষ পর্যন্ত উর্দুর পাশাপাশি বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়, কিন্তু তা অর্জিত হয় রক্তপাতের মাধ্যমে। বিলম্বে প্রদান করা অধিকার বাঙালিদের ক্ষোভ খুব কমই প্রশমিত করতে সমর্থ হয়।

ভাষা-বিতর্ক পূর্ব পাকিস্তানীদের মধ্যে দ্রুত বেড়ে ওঠা অনুভবের নির্দেশক। তারা মনে করেছে আগে তারা মাড়োয়াড়ী ও পশ্চিমবঙ্গের জোয়াল কাঁধে নিয়েছে, এখন নিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানীদের। দেশভাগের সময়ে অবিভক্ত ভারতে পুরো বেসামরিক প্রশাসনে মাত্র একজন পূর্ব বাংলার মুসলমান কর্মকর্তা ছিলেন। আর ১৯৫৬ সালের পর থেকে পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসনে কঠোর কোটা-পদ্ধতিতে লোক নেয়া হলেও এখন পর্যন্ত প্রশাসনে পূর্ব পাকিস্তানের তিনজন যুগ্ম সচিব, ১০ জন উপ-সচিব এবং ৩৮ জন নিম্ন সচিব রয়েছেন। এর বিপরীতে ঐ পদগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংখ্যা যথাক্রমে ৩৮, ১২৩ ও ৫১০। বিভাগপূর্ব সময়েই সামরিক বাহিনীতে পাঞ্জাবী ও পাঠানদের প্রাধান্য ছিল, বিভাগপরবর্তী সময়ে তাদের প্রাধান্য আগের চাইতে আরও বেড়েছে। ১৯৫৬ সালের পর থেকে পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি ঘটেছে কিন্তু বৈষম্য থেকেই গেছে।

বেসামরিক, রাজনৈতিক ও সামরিক — ক্ষমতার এই তিন হাতিয়ারের সমাবেশ ঘটেছে পাকিস্তানের তিনটি শহরে, কিন্তু শহর তিনটিই পাঞ্জাব রাজ্যে অবস্থিত। এতে আন্তঃঅংশ বিরোধ বেড়েছে। ১৯৫৫ সালে সিন্ধু, বেলুচিস্তান, সীমান্ত প্রদেশ ও পাঞ্জাব মিলে একটি অংশের সৃষ্টি হবার পর লাহোর পশ্চিম পাকিস্তানের রাজধানী হয়। ১৯৫৯ সালে আইয়ুব খানের একক সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের রাজধানী করাচি থেকে ইসলামাবাদে নিয়ে আসেন। এতে দেশের রাজধানী হয় পাঞ্জাবেরই একটি শহর। রাওয়ালাপিন্ডি তো সশস্ত্রবাহিনীর হেডকোয়ার্টার ছিলই।

আইনসভায় এক ইউনিট ব্যবস্থা কেবল আন্তঃপ্রদেশ বিরোধ বাড়িয়েই তোলে নি, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে পরস্পরের শত্রুভাবাপন্ন করে ফেলেছে। দেশভাগের পরপরই যে-আইনসভা গঠিত হয়েছিল সেখানে ৬৯টি আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ছিল ৪৪টি। নতুন পদ্ধতিতে এই প্রতিনিধিত্ব পশ্চিম পাকিস্তান দ্বারা নির্ধারিত হতো। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সম্প্রতি এই ইউনিট পদ্ধতি ভেঙ্গে তা সংশোধনের উদ্যোগ নেন। তার উদ্যোগ মোতাবেক প্রতিটি প্রদেশ তার জনসংখ্যার ভিত্তিতে আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব করবে। এভাবে ৩১৩টি আসনের জাতীয় আইনসভায় পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ প্রতিনিধিত্ব থাকবে।

পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষোভের কিছু যথার্থ কারণ আছে। কিন্তু এর সবটাই পশ্চিম পাকিস্তানের কারণে হয় নি। ইতিহাস ও ভূগোল সেখানে অর্থনৈতিক স্থবিরতা এনে দিয়েছে। ভারত বিভাগের পূর্বে পূর্ব বাংলা ছিল সবচেয়ে অনুন্নত এলাকার একটি। কৃষিনির্ভর এই অঞ্চলটি পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়িত অঞ্চলের জন্য কাঁচামালের যোগানদার-ভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পূর্ব বাংলার রফতানি-কেন্দ্র চট্টগ্রামকে প্রতিদ্বন্দ্বী কলকাতার কারণে অনুন্নত রাখা হয়েছে। পূর্বের জেলাগুলো পুরোপুরিভাবে অবহেলা করা হয়েছে ও অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। এই অবস্থা দূর করতে ভাইসরয় লর্ড কার্জনের উদ্যোগে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হয়। কিন্তু এই বিভাগ স্বল্পস্থায়ী হয়। বাঙালি হিন্দুরা এর বিরুদ্ধে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং ১৯১১ সালে আবার বাংলা এক হয়ে যায়। ১৯৪৭ সালে আবার তারা পৃথক হয়ে যায়। আজ দু-অংশই উত্তাল। নিকট ও দূর ভবিষ্যতে পূর্ব পাকিস্তানের চূড়ান্ত পরিণতি কী হবে তা বলা কঠিন। কিন্তু ভারতের একটি অংশ হতে এর কোনো ইচ্ছা নেই। ঐধরনের একত্রীকরণের অসুবিধা কী তা স্পষ্ট। পাকিস্তানে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু ভারতে তারা হবে সাত ভাগের এক ভাগ। পাকিস্তানে তারা অর্থনৈতিক সম্পদের একটি বড়ো অংশের ভাগ পেতে পারে, কিন্তু ভারতে সম্পদের ভাগ পেতে অন্যান্য অনেক অঞ্চলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে। এর নতুন পাটকলগুলোকে কলকাতার কলগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে, কলকাতা বন্দরের সঙ্গে উন্নয়নশীল চট্টগ্রাম বন্দরকে মোকাবেলা করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে একত্রিত বাংলার আত্মপ্রকাশও একটা ফলাফল হিসেবে কেউ ভাবতে পারেন, কিন্তু তা হবার সম্ভাবনাও খুব কম। ১৯৪৭ সালে শরৎ চন্দ্র বসু ও সোহরাওয়ার্দি এরকম একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু তা কার্যকর হয় নি। কিন্তু পূর্ব বাংলা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে লীন না হবার ব্যাপারে খুবই সচেতন। আর এধরনের একত্রীকরণ করতে হলে পশ্চিমবঙ্গকে ভারত থেকে পৃথক হতে হবে — কিন্তু এধরনের যেকোনো উদ্যোগ ভারত শক্ত হাতে প্রতিরোধ করবে।

পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একমাত্র বিকল্প হলো পূর্ণ স্বাধীনতা অথবা পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে শিথিল ফেডারেশন। পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান নেতৃত্ব স্বাধীনতার ক্ষেত্রে খুব আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না। পূর্ব পাকিস্তান ব্যাকুলভাবে যেটা চাচ্ছে সেটা হলো তারা নিজেরাই নিজেদের শাসন করবে — তারা চায় পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। নিজ শাসন বা স্বরাজ যাই বলুন না কেন, তারা তাই করতে চায়, যদি সম্ভব হয় তবে পশ্চিম পাকিস্তানের সহযোগিতা নিয়েই। যদি পূর্ব পাকিস্তানীদের নিশ্চয়তা দেয়া হয় যে তাদের ঘরের তারাই প্রভু, তবে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে ফেডারেল সরকারব্যবস্থায় অংশ নেবে। সেখানে দুর্বল কেন্দ্র থাকতে হবে এবং কেন্দ্র তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তপে করবে না। ভারত একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র কিন্তু একটি সংবদ্ধ ভূখণ্ড। পাকিস্তান একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র কিন্তু বিভক্ত ভূখণ্ড। এই দুই রাষ্ট্রেরই ভবিষ্যত হলো শিথিল ফেডারেল কাঠামোর। উভয় দেশকেই আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক চেতনাকে সত্যিকারের মর্যাদা দিতে হবে এবং দু-দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। দেশবিভাগ হয়েছিল মুসলমান-অধ্যুষিত প্রদেশগুলোর ওপরে হিন্দু আধিপত্যের ভয় থেকে। পূর্ব পাকিস্তানের ওপরে পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্য একইভাবে অমীমাংসিত প্রমাণিত হয়েছে।

১৯৪৭ সালের পূর্বের পাকিস্তান-আন্দোলনের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের দাবির মিল রয়েছে। হিন্দির আধিপত্যের বিপরীতে উর্দুকে রক্ষা, আইনসভায় ও চাকরিতে মুসলমানদের অংশভাগ, কংগ্রেসের শক্তিশালী কেন্দ্রের পক্ষে মতের বিপরীতে মুসলমানদের ফেডারেল কাঠামোর দাবি এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলমানদের আরও ক্ষমতার দাবিসহ অনান্য কিছু কারণই ছিল ভারতবিভাগের কারণ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান-আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী মুসলিম লীগ আইনসভা বয়কট করেছিল। ইতিহাস কি তার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে?

[ড. জাইদ লন্ডন ইউনিভার্সিটির প্রাচ্য ও আফ্রিকা অধ্যয়ন স্কুলের ইতিহাসের প্রভাষক।]

পুরনো পাকিস্তানের সমাপ্তি

দি টেলিগ্রাফ, ১০ মার্চ ১৯৭১

ডেভিড লোশাক

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

ঢাকা। ভারতীয় উপমহাদেশে দেশবিভাগের কোলাহলের মধ্যে জন্ম নেয়া, অযোগ্য রাজনীতিবিদ ও অপরিণামদর্শী জেনারেলদের মাধ্যমে খুঁড়িয়ে চলা, জিন্নাহ-সৃষ্ট, ইসলামের প্রতি অনুরক্ত পাকিস্তান রাষ্ট্র এখন মৃত। গত দুই সপ্তাহের দৃশ্যপট ও নিপীড়নমূলক রাজনীতির পর বলা যায় পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে যাওয়াটাই সমাধান হতে পারে। ১২ কোটি পাকিস্তানীর, বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানের শোষিত ৭ কোটি বাঙালির দুঃখজনক অতীতের চাইতে মলিন ভবিষৎ অপেক্ষা করছে।

শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণআন্দোলন দানা বেঁধে ওঠার ফলে যে-সংকট সৃষ্টি হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকারকে তা বিপদে ফেলে দিয়েছে। আর যদিও হবার কথা নয় তবু, রক্তপাত ছাড়াই, কোনোক্রমে তার সমাধান হতে পারে। কিন্তু বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের নেতারা যে আপসরফাই করে থাকুন না কেন, দুই জাতিকে একত্রে রাখার যে-নিরীক্ষা করা হয়েছে, তা ব্যর্থ হয়ে পড়েছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে খুবই সাধারণ একটি সত্য যে এখানে দুই জাতি রয়েছে। এদের কোনো সাধারণ স্বার্থ নেই, কোনো পারস্পরিক নির্ভরতা নেই, কোনো সাধারণ ভাষা বা খাদ্যাভ্যাস নেই এবং এমনকি ইসলামও তাদের একত্রে রাখতে পারে না।

শেষ যে-বিষয়টি বোঝার দরকার তা হলো, ইসলাম কোনো ঐক্যের শক্তি নয়। এটা মধ্যপ্রাচ্যে প্রমাণিত হয় নি; এখানেও হচ্ছে না।

ভারতীয় শত্রুতা

দেশটির দুই অংশের মধ্যে অনেক পার্থ্যক্যের সঙ্গে, যার অনেকগুলোই মীমাংসা করা সম্ভব নয়, যোগ হয়েছে এই ভৌগোলিক সত্যটি: দু-টি অংশ এক হাজার মাইলের শত্রুভাবাপন্ন ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা বিচ্ছিন্ন। দুই অংশের মধ্যে আকাশপথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে গত মাসে ভারত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে এই পরিস্থিতির আরও অবনমন ঘটে। কোনো আধুনিক রাষ্ট্রই — অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে এবং সবচেয়ে বড়ো কথা ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে — টিকে থাকতে পারে না। পাকিস্তানের নেতারা ২৩ বছরের উদ্বিগ্ন সময়ে স্থিতিশীল, স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করতে ব্যর্থ হবার পেছনে এগুলোই হলো কারণ। একই কারণে পাকিস্তান সবসময়ই রোগগ্রস্ত থেকেছে। কিন্তু এর সমাধান হিসেবে পাকিস্তান দু-টুকরো হয়ে যাচ্ছে যা আবার আগের রোগের চেয়েও মারাত্মক। এখন দীর্ঘদিনের সংঘাত ফুটন্ত কড়াইয়ের পানির মতো ফুটছে, নেতাদের ফিরে আসার আর কোনো উপায় নেই।

দু-জন পাকিস্তানী এবং তার বন্ধুরা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ এই বিভক্তির জন্য দায়ী। গত ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এসবকিছু ঘটছে। বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা দেবার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ফর্মুলা খুব মসৃণভাবে ও সুষ্ঠুভাবে কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে।

১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান কার্যত পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। এই প্রথমবারের মতো পূর্ব পাকিস্তান সরকারব্যবস্থায় তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। এটাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। নির্বাচন অযোগ্য রাজনীতিবিদ ও হঠকারী জেনারেলদের জবাব দেয়। প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও গরীব মানুষের মিলিওনার নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো ‘ইসলামিক সমাজতন্ত্র’-এর কথা বলে পশ্চিম পাকিস্তানের ১৩৮টি আসনের মধ্যে ৮৫টি আসন লাভ করেন। বাঙালিদের প্রিয় জননেতা শেখ মুজিবুরের দল আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২ টি আসনের দু-টি ছাড়া সব আসনই লাভ করে। নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের ইস্যুর আবেগকে কাজে লাগিয়ে মুজিব এই সাফল্য পান। এভাবে তিনি ৩০০ আসনের আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন।

এর পরে মনে হয়েছিল রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের স্বার্থে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নে সম্মত হবেন যার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দৃশ্যপট থেকে সরে যাবেন। এক্ষেত্রে আদর্শগত দিক থেকে তাদের বিভক্তি কম ছিল, এবং উভয় নেতাই সংবিধান-ইস্যুতে আপস করতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু নির্বাচন কেবল দুই-দল-ব্যবস্থাই তৈরী করে নি, এটা এমন এক দুই-দল-ব্যবস্থা করে যাতে জনসংখ্যার কারণে পূর্ব পাকিস্তান ক্ষমতাসীন পশ্চিম পাকিস্তানকে শাসন করবে এবং বিরোধী দল কখনোই রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসতে পারবে না। এই ফলাফল দুই অংশের মধ্যে পার্থক্য তৈরী করে।

নিজেদের মর্যাদা রক্ষার জন্য এবং উপনিবেশ ঠেকাতে পূর্ব পাকিস্তান প্রায় পুরোমাত্রার স্বায়ত্তশাসন চাচ্ছে যা আওয়ামী লীগের ‘ছয় দফা’-র ভিত্তিতে চাওয়া হচ্ছে। এর অধীনে নিজেদের রাজস্ব ও ব্যয়, বৈদেশিক সাহায্য, বৈদেশিক বাণিজ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিজেদের অধীনে থাকবে এবং কেবল প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি, এবং সম্ভবত মুদ্রা একটি দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে। পশ্চিম পাকিস্তানে এই প্রস্তাব ঘৃণার জন্ম দিয়েছে। এটা মি. ভুট্টোর কাছে গৃহীত হয়নি — কেবল এজন্য নয় যে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাতে ব্যাহত হবে — আরও একটি ব্যাপার হলো, তার দর্শন অনুসারে ভারতের সঙ্গে হাজার বছরের যুদ্ধ চালাতে হলে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার দরকার।

ইয়াহিয়ার কাছেও এটা গ্রহণযোগ্য ছিল না। তার মনে হয়েছে এতে পাকিস্তানের সংহতি নষ্ট হবে। এটা পাঞ্জাবী-প্রাধান্যের-সেনাবাহিনীর কাছেও গৃহীত হয় নি। তারা পূর্ব পাকিস্তানে গণতন্ত্র দিতে চায়, কিন্তু তা এমন কোনো গণতন্ত্র নয় যে, বাঙালি-সংখ্যাগরিষ্ঠতার সেনাবাহিনীবিমুখ সরকারের প্রতি চিরদিনের জন্য তাদের মুখাপেক্ষী থাকতে হয়। আর এটা অগ্রহণযোগ্য ছিল অন্য রাজনৈতিক কারণে। এরকম স্বায়ত্তশাসন পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশকেও অনুপ্রাণিত করবে এবং পাকিস্তানের সংহতি আরও সংকটের মুখে পড়বে। তাই আইনসভা বসার আগেই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।

ভুল পদ্ধতি

এরকম গুরুতর সময়ে ইয়াহিয়া ভুল পথে এগোলেন। ইয়াহিয়া আইনসভার অধিবেশন স্থগিত করলে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। এক সপ্তাহের আন্দোলনের পর তিনি ২৫ মার্চ অধিবেশনের নতুন তারিখ ঘোষণা করেন, কিন্তু তার বেতার ভাষণ শুনে বাঙালিরা তার ইচ্ছার সামঞ্জস্য খুঁজে পায় নি। জেনারেলের চাইতে তিনি সার্জেন্ট মেজরের স্টাইলে পদক্ষেপ নেয়ায় তা পূর্ব পাকিস্তানের অধৈর্য জনতাকে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয় এবং স্বাধীন ‘বাংলাদেশ’-এর ঘোষণা দেয়া থেকে বিরত থাকার মতো কিছু বলে তাদের আশ্বস্ত করতে পারেন নি। রোববারে শেখ মুজিব এই ঘোষণার কাছাকাছি চলে এসেছেন, সেনাবাহিনীর তড়িৎ ও কঠোর প্রতিক্রিয়া ছাড়াই তিনি এটা করতে পারতেন। সেনাবাহিনী যেকোনো ধরনের বিচ্ছিন্নতার আন্দোলনকে প্রতিহত করবে, এর অর্থ অনেক রক্ত ঝরবে।

যদি ‘বাংলাদেশ’ স্বাধীনতা লাভও করে, তবে তার নিজেকে পুনরুদ্ধার করতে হবে এমন একটি অর্থনীতি থেকে যা ইতোমধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত। কিন্তু যদি একে প্রতিহত করা হয় বা দমন করা হয়, তবে ক্রমবর্ধমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনাকে কীভাবে হজম করা যাবে? আর দখলদার বাহিনী দিয়ে একটি জাতিকে কীভাবে দমিয়ে রাখা যাবে, যে-বাহিনীর ঘাঁটি এক হাজার মাইল দূরে? যদি পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তবে পশ্চিমেও একইভাবে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হবে, অর্থনৈতিক অবস্থা সেখানেও ভালো নয়।

পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবালী ভারতের সমস্যা-রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও গভীর প্রভাব ফেলবে। মার্কসীয় নেতা জ্যোতি বসু তার নিজস্ব ‘ছয় দফা’ দাবি করে দিল্লি থেকে পৃথক হতে চাইছেন। এসব হচ্ছে কেবল এজন্য নয় যে সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় বেশ কিছু চীনা ‘পর্যবেক্ষক’-কে দেখা যাচ্ছে।

৭ই মার্চের ভাষণের পরে

দি টাইমস, ৮ মার্চ, ১৯৭১

পল মার্টিন

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক


আপস অথবা সরাসরি সংঘাত: পূর্ব পাকিস্তানে দ্বিধাগ্রস্ত

ঢাকা, মার্চ ৮। আজ পাকিস্তানের সংকট নতুন পর্বে প্রবেশ করেছে। কারণ দেশটির উভয় অংশকেই আজ রাজনৈতিক আপস অথবা সরাসরি সংঘাতের মধ্যে একটিকে বেছে নেয়ার পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল যে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বক্তৃতা দিয়েছেন, তা থেকে মনে হচ্ছে আপসের কিছু সুযোগ এখনও রয়েছে। তিনি বলেছেন ২৫ মার্চে অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আইনসভায় বসতে রাজি হবার ক্ষেত্রে সামরিক সরকারকে অন্তঃত চারটি শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হবে। গত কয়েক সপ্তাহে ঢাকা এবং পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য অংশে যে-উত্তেজনা দেখা গিয়েছে, তা এখনও বলবৎ রয়েছে কিন্তু এরপরও শ্বাস ফেলার সময় তৈরী হয়েছে। বিপদের কথা এই, উভয় পক্ষের সামরিক ও বেসামরিক জঙ্গীরা বিশেষত পূর্বের মুজিববাদী চরমপন্থী ছাত্ররা সংকটকে পুনরায় চরম গভীরে ঠেলে দিতে পারে।

পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যত যে অনিশ্চিত তা বোঝা যাচ্ছে বিদেশী নাগরিকদের মধ্যে যারা দেশে ফিরে যেতে আগ্রহী তাদের ফিরে যাবার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। প্রথম ব্যাচ হিসেবে জার্মানীদের একটি দল, যাদের মধ্যে দূতাবাসের স্টাফ ও পরিবার রয়েছে এবং কর্মরত অন্যরা আজ ব্যাংককে চলে গেছেন। ব্রিটিশদের মধ্যে দেশে ফিরে যাবেন তাদের জন্য একটি বোয়াক ভিসি টেন এয়ারলাইন অপো করছে আগামীকাল ঢাকা ছাড়ার জন্য। যদিও সবাইকে চলে যাবার ঘোষণা দেয়া হয় নি, তবুও কোনো সরকার সতর্ক হবার প্রয়োজন মনে করছে। বিগত সপ্তাহগুলোর ব্যাপক মিছিল-বিক্ষোভে থেকে অবশ্য বিদেশীদের বিরুদ্ধে কোনো হুমকি দেয়া হয় নি। কিন্তু যেহেতু আইন-কানুন পরিস্থিতি ভালো নয়, তাই এই মনোভাব যে পরিবর্তিত হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

বাঙালিদের জন্য ইস্যুটি খুব পরিস্কার: শেখ মুজিবুর ও তার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যেতে দিতে হবে, যারা পরিস্কার সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে নির্বাচনে জিতেছে, অথবা নির্বাচনটিই প্রহসনে পরিণত হচ্ছে। শেখ পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র কার্যকর শক্তি বলে এতোকিছু সম্ভব হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু বর্তমানে শেখের অবস্থান সাংঘাতিক ভালো। ৩ মার্চের সংসদীয় অধিবেশন স্থগিত করার পর আওয়ামী লীগের ডাকে ঢাকায় হরতাল পালিত হচ্ছে।

যদিও প্রদেশজুড়ে প্রয়োজনীয় সেবা পুনরুদ্ধার করা হয়েছে, কিন্তু সব সরকারী-বেসরকারী অফিস, স্কুল ও ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকবে। রাজস্ব প্রদান স্থগিত থাকবে, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ব্যাংকিং লেনদেন বন্ধ থাকবে এবং পরবর্তী নির্দেশ না-দেয়া পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে চালু পশ্চিম পাকিস্তানের একাউন্ট বন্ধ থাকবে। শেখ পশ্চিমের সঙ্গে যে-অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু করেছেন, এর ফলে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গুরুতর সমস্যা তৈরি করবে। বাঙালিরা বিশ্বাস করে যেহেতু তাদের বেশিরভাগ উৎপাদিত পণ্য পশ্চিম থেকে আসে, তাই বাণিজ্য বন্ধ হলে তারা এর প্রভাব হাড়ে হাড়ে টের পাবে।

শেখ আরেক জায়গায় জয়ী হয়েছেন। তার অসহযোগ আন্দোলন কাজে দিচ্ছে। ব্যপারাটা বোঝা গেল, যখন গতকালের বিশাল জনসভায় তিনি যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন ঢাকার বেতারকেন্দ্র তা প্রচার করতে রাজি হলো। কিন্তু সময়মতো তা সম্প্রচারিত হয় নি। বিক্ষোভকারীরা এর প্রতিবাদ জানায় এবং বেতারকেন্দ্রে ঘরে-তৈরী-বোমা নিক্ষিপ্ত হয়।

পাকিস্তান: ভাঙ্গন রোধে ইয়াহিয়া সেনাবাহিনী ব্যবহার করবেন

দি অবজারভার, ৭ মার্চ, ১৯৭১

সিরিল ডান

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্তাল কেন্দ্র ঢাকা আজ যে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে তার ফলে দেশটিতে গৃহযুদ্ধের সূচনা করতে পারে। এর ফলে মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানে স্বাধীনতা লাভের ২৫ বছর পর দ্বিখণ্ডিত হয়ে যেতে পারে। পূর্ব পাকিস্তানের ৫০-বছর-বয়সী রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল ঘোষণা করেছেন যে আজ ঢাকার পল্টন ময়দানে একটি গণসমাবেশে করবেন। তার আন্দোলনের সেনাপতিরা বলছেন আজ মুজিব একটি ‘ঐতিহাসিক বক্তৃতা’ করবেন, যার অর্থ পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পৃথক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেবেন।

এই সম্ভাবনার কথা বুঝতে পেরে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান — যিনি এখনও সামরিক শাসক হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ মতা ধারণ করেন — গতকাল দুপুরে এক বেতার-ভাষণে দৃঢ়ভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন যে তিনি পাকিস্তানের ভাঙ্গন বরদাশত করবেন না। তিনি তার ভাষণে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন যে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক হস্তপে করতে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘যাই ঘটে থাকুক না কেন যতণ পর্যন্ত আমি পাকিস্তান-সেনাবাহিনীর প্রধানের দায়িত্বে আছি, পাকিস্তানের সম্পূর্ণ ও পরম অখণ্ডতা রা করবো। এবিষয়ে যেন কোনো সন্দেহ কারো মনে না থাকে। আমি সামান্য কয়েকজন লোককে কোটি মানুষের পাকিস্তান ভূমিকে ধ্বংস করার সুযোগ দিতে পারি না’।

একই সময়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আজ ঢাকায় চরম বিক্ষুব্ধ প্রদর্শনীকে রোধ করার জন্য ও পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করার জন্য দু-টি পদপে গ্রহণ করেছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে নির্বাচিতরা ২৫ তারিখে একটি সংবিধান প্রণয়নের জন্য আইনসভার অধিবেশনে বসবেন। সংবিধান অনুসারে মতা সেনাবাহিনীর হাত থেকে জনগণের কাছে হস্তান্তরিত হবার কথা। ডিসেম্বরের ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি আসনেই জয়ী হন কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো সমর্থনই পান নি।

শেখ যখন পুরো পাকিস্তানের জন্য সংবিধান প্রণয়ন করতে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য এমন এক ধরনের স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা দিতে চাইলেন যার প্রকৃতি স্বাধীনতার চেয়ে সামান্য দূরবর্তী একটি অবস্থান, তখনই বর্তমান সংকট তৈরী হলো। এর ফলে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রি ও পশ্চিমাংশে বিজয়ী পিপলস্ পার্টির প্রধান মি. জুলফিকার আলি ভুট্টো প্রথম জাতীয় পরিষদের ৩ মার্চ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য অধিবেশন বয়কট করেন। এর পরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ‘অনির্দিষ্টকাল’-এর জন্য অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন এবং এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ পূর্ব পাকিস্তানে তাৎণিকভাবে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হত্যার ঘটনা ঘটে। মৃতের সংখ্যা কত তা কঠোর সেন্সরশিপের কারণে তাৎণিকভাবে জানা যায় নি, তবে গত শুক্রবারে একটি এজেন্সি-প্রতিবেদন থেকে জানা যায় সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে ২,০০০ লোক মারা যায়।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গতকাল এটাও ঘোষাণা করেছেন যে তিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পূর্ব পাকিস্তানে যাচ্ছেন। পদপেটি সাহসী, এমনকি বেপরোয়াও বলা যায় একে। পূর্ব পাকিস্তানে এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে ইয়াহিয়ার পূর্বসূরী ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পতন ঘটিয়েছিল। এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে যাবার মাধ্যমে নিজের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলছেন। তিনি যদি সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতবাদীরা ‘সামান্য কয়েকজন’ তবে শিগগীরই তিনি দেখতে পাবেন যে তার জানার মধ্যে গলদ আছে।

এটা শোনা যায় যে সংকট সৃষ্টি হবার পর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আড়াই ডিভিশন সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থান করছে। তার পর থেকেই এর সংখ্যা বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ১০০০ মাইলেরও বেশি ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা বিচ্ছিন্ন।

এটা শোনা যায় যে সংকট শুরু হবার পর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আড়াই ডিভিশন সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থান করছে। তার পর থেকেই সৈন্যসমাবেশ ক্রমশ বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ১০০০ মাইলের ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা বিচ্ছিন্ন। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পূর্বে দু-জন কাশ্মিরী ভারতীয় এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ছিনতাই করে লাহোরে নিয়ে যাবার পর থেকে ভারতীয় ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে পাকিস্তানী বিমান চলাচলের ওপর ভারত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। পাকিস্তানের বিমানগুলোকে তাই পুরো ভারত-সীমান্ত ঘুরে শিলং-এর পথ ধরে আসতে হয়। ভারতীয় প্রতিরামন্ত্রি জগজীবন রাম বলেছেন পাকিস্তানের সংকট সত্ত্বেও এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। শেখ মুজিবুরের স্বায়ত্তশাসিত পূর্ব পাকিস্তানের পরিকল্পনায় স্থানীয় মিলিশিয়া বাহিনীর কথাও রয়েছে। অবশ্য তার অস্তিত্ব এখনও নেই, আর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কেবল একটি রেজিমেন্টেই পূর্ব পাকিস্তানী সদস্য রয়েছে।

গতকাল লন্ডনে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় শেখ মুজিবুর “এখনও একক পাকিস্তানের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন”, কিন্তু “পুরো জনগোষ্ঠীর চাপ রয়েছে যে তিনি যেন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে ‘জাহান্নামে যাও’ বলে বিদায় করে দেন”। শেখ সবসময় বলে এসেছেন যে পূর্ব পাকিস্তান “পশ্চিম পাকিস্তানের একটি অবহেলিত উপনিবেশ এবং তার স্বায়ত্তশাসন পরিকল্পনা এই শোষণ থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত করবে”।

আমাদের প্রতিনিধি মৃতের সংখ্যা ‘প্রায় ২০০’ বলে উল্লেখ করেছেন এবং জানাচ্ছেন এই সংখ্যাটি প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে কম কারণ সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে, যদিও পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র বিক্ষুব্ধ জনতা কারফিউ ভঙ্গ করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। শেখ তার জনগণকে শান্ত থাকার আবেদন জানিয়েছেন এবং তার নির্দেশ না-দেওয়া পর্যন্ত তারা যেন উচ্ছৃঙ্খল আচরণ না-করে ও পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। এই মুহূর্তে বাঙালিরা অবশ্য শেখ যা বলবেন তা যাই হোক না কেন করতে রাজি আছে। কিন্তু তাদের মেজাজ বিগড়েও যেতে পারে যদি তিনি তাদের প্রত্যাশা পূরণ না করেন।

আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন যে সেনাবাহিনী অস্ত্র ব্যবহার করছে। দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন ‘বাংলার নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে’ নগ্নভাবে সেনাবাহিনীকে ব্যাবহার করা হচ্ছে। বিােভ আরও ছড়িয়ে দেবার জন্য তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের কাছে ‘অবিলম্বে’ পূর্ব পাকিস্তানে সেনাভিযান বন্ধের দাবি জানানোর আবেদন জানিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন যে তারা ‘দখলদার বাহিনীর মতো’ আচরণ করছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ওপরে ‘উৎপীড়ন’ বন্ধ করতে ইয়াহিয়ার ওপরে চাপ প্রয়োগের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি অনুরোধ করেছেন এমন তথ্য ভারতীয় বেতার আকাশবাণীতে প্রচার হবার পর তা অস্বীকার করেছেন।

জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে ইয়াহিয়া খান বলেন ডিসেম্বরে পাকিস্তানের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার পর ‘আমি জনগণের কাছে মতা হস্তান্তরের জন্য যতগুলো পদপে গ্রহণ করেছি তার প্রতিটি কয়েকজন নেতার জন্য বাধাগ্রস্ত হয়েছে’। তিনি বলেন তিনি অধিবেশন স্থগিত করেছেন পরিস্থিতি শান্ত হবার জন্য, কিন্তু তার এই পদপেকে ‘পুরোপুরিভাবে ভুল বোঝা’ হয়েছে। তিনি বলেন পূর্ব পাকিস্তানের গণ্ডগোল থামাবার জন্য তিনি সর্বনিু সংখ্যায় সেনাবাহিনী ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি পাকিস্তানীদের উদ্দেশ্যে ‘আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ও আল্লাহর ওপরে ভরসা রেখে একটি গণতান্ত্রিক জীবনপদ্ধতির দিকে এগিয়ে যাবার’ আহ্বান জানান।

নির্বাচনের পর থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টোর সঙ্গে ব্যক্তিগত আলোচনায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন ভারতবিভাগের আগে, যখন ভারতীয় মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রের পরিকল্পনা করা হচ্ছিল, তখনই পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয়েছিল কিন্তু পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তানকে ‘প্রতারণা’ করা হয়েছে। তিনি বলেন ১৯৪০ সালের মার্চে মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবে ‘স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের’ কথা বলা হয়েছিল যেখানে রাষ্ট্রগুলো হবে ‘স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম’।

জাতীয় পরিষদ বসলে যে নতুন সংবিধান প্রণীত হবার কথা সেখানে শেখ যিনি সভার সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধি কেন্দ্রের হাতে কেবল পররাষ্ট্র ও প্রতিরা রাখতে চান। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে রাজস্ব ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কেন্দ্র কোনো খবরদারি করতে পারবে না। তার মতে এই দুইটি ক্ষেত্রে বিশেষত পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক ‘শোষিত’ হয়ে এসেছে। শেখ ইতোমধ্যে ইয়াহিয়ার সঙ্গে একমত হয়েছেন যে প্রাদেশিক রাজস্বের আনুপাতিক একটি অংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিরা-বাজেটে চলে যাবে। কিন্তু বাঙালিদের প্রবল আপত্তি ঐখানে যে তাদের রাজস্বের ৭০ ভাগই সেনাবাহিনী, পররাষ্ট্র ও মুদ্রাবিনিময়ের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

তারা ক্ষুব্ধ এজন্য যে ৩০০,০০০ সৈন্যের পাকিস্তান বাহিনীকে পোষার জন্য তাদের রাজস্ব ব্যয় করতে হয়। আর সেই সেনাবাহিনীর প্রধান কাজ হলো কাশ্মির ইস্যুতে ভারতের বিরুদ্ধে সংঘাতে নিয়োজিত থাকা। কিন্তু কাশ্মির বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের মতো সংশ্লিষ্টতা বোধ করে না। উপরন্তু বাংলা ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে খুবই আগ্রহী যা ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর থেকে বন্ধ হয়ে আছে। যদিও অনেক ভারতীয় পাকিস্তানের অস্তিত্ব নিয়েই খেদ ব্যক্ত করে থাকে কিন্তু পাকিস্তানকে দু-টি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে তাদের আপত্তি নেই। ভারতের সরকারী পর্যবেণ হলো যদি পাকিস্তানের নতুন জাতীয় পরিষদে মুজিবুর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর পে নেতৃত্ব দেন তবে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের সম্ভাবনা কমে যাবে।

ভারত এটাও বিশ্বাস করে যে পূর্ব পাকিস্তান যদি ভেঙ্গে আসে তবে তার অর্থনৈতিক অবস্থার সম্ভবত আরও অবনমন হবে। সেক্ষেত্রে এখনকার জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যর্থতা চিহ্নিত হতে পারে। স্থানীয় সমাজতন্ত্রীরা এতে অস্থির হয়ে উঠবে এবং একসময় পশ্চিমবঙ্গের শক্তিশালী সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে তারা জোট বাঁধতে চাইবে। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা খুব একটা উজ্জ্বল নয়। একসময়ে সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের বৈদেশিক আয় পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় বেশি ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি আর সেরকম নেই। পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্বের চাইতে সফলভাবে শিল্পায়ন ঘটানো হয়েছে। ‘ঔপনিবেশিক শোষণের ত্রে’ পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প প্রায় পুরোপুরি পাটের ওপরে নির্ভরশীল।

পূর্ব পাকিস্তান হলো পৃথিবীর মধ্যে প্রথম এলাকা যেখানে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের বাস্তবতা নির্মম আকারে দেখা দিয়েছে। এখানে প্রতি বর্গমাইলে ১,৩০০ জন মানুষ বাস করে ও প্রতি বছর এর এক-তৃতীয়াংশ ভূ-ভাগ বন্যায় প্লাবিত হয় এবং অধিবাসীদের অন্যত্র বসতি স্থাপনেরও সুযোগ নেই। বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ মনে করেন যেমন আছে, এঅবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের এককভাবে এগিয়ে যাবার ক্ষমতা নেই।