Author Archives: Webmaster

পূর্ব পাকিস্তানের নেতা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন

দি টাইমস, ৬ মার্চ, ১৯৭১

পিটার হ্যাজেলহার্স্ট

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

করাচি। বিক্ষোভে উত্তাল পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে এখন দুটি বিকল্প আছে: তিনি এককভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন অথবা তিনি নিজেই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকতে পারেন এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সেখানে যোগ দিতে আহ্বান জানাতে পারেন। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জেড. এ. ভুট্টো নিশ্চিতভাবেই তাতে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানাবেন কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট প্রদেশগুলোর নেতারা শেখ মুজিবুরের সঙ্গে হাত মেলানোর জন্য প্রস্তুত থাকবেন।

পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশ দু-দশক ধরে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায় প্রাধান্য বিস্তার করে আসছে। কিন্তু বর্তমানে তারা বুঝতে পেরেছেন যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পাকিস্তানকে একত্রিত রাখতে চাইলে বাঙালির শাসনকেই মেনে নিতে হবে কারণ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কল্যাণে আইনসভায় তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ক্ষমতাসীনদের মধ্যে যেসব শান্তিকামী রয়েছেন, যারা মনে করেন যে ক্ষমতায় বাঙালিদের প্রাপ্য ভাগ দেয়া দরকার, তারা পরাস্ত হয়েছেন। আর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে তিনি হয়তো কট্টর পাঞ্জাবীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। অন্যদিকে সেনাবাহিনীর মধ্যে এই ভীতি কাজ করছে যে যদি বাঙালিরা ক্ষমতায় আসে তবে সামরিক বাহিনী কর্তন করে তার আকার ছোট করে ফেলা হবে।

সেনাবাহিনীর হাতে এক যুগ ধরে দমন-পীড়নের শিকার হবার কারণে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে যে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা হ্রাস করা হবে। তাই এটা পরিস্কার যে পাঞ্জাবীদের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী প্রেসিডেন্টকে প্রভাবিত করেছে সংবিধান রচনার পরিষদকে রদ করার জন্য। বোঝা যাচ্ছে এসপ্তাহের প্রথমার্ধে প্রেসিডেন্টকে বোঝানো হয়েছিল অধিবেশন প্রত্যাহার করে নিলে বাঙালিরা সামরিক শৌর্য্যরে কাছে নতজানু হবে। পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় গভর্নর ভাইস এডমিরাল এস এম আহসান পরে পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টকে অধিবেশন স্থগিত করার বিপরীতে তার পরামর্শ দেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার মন্ত্রিসভার কট্টরপন্থীদের পরামর্শেই কাজ করেন। বাংলায় পরিস্থিতির অধিক অবনতি এডমিরাল আহসানের অবস্থানকেই সত্য প্রমাণ করেছে এবং প্রেসিডেন্টকে এখন পেছনে ফিরে আসতে হবে এবং অধিবেশনের একটি নতুন তারিখ ঘোষণা করতে হবে।

ইয়াহিয়া খানের প্রশাসনের সামরিক পর্যবেক্ষকরাই স্বীকার করেছেন যে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ঠেকিয়ে রাখা খুব কঠিন হবে এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া পূর্ব পাকিস্তানের ৭৫ মিলিয়ন মানুষকে বলপূর্বক দমিয়ে রাখা যাবে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক কিছু নির্ভর করছে মি. ভুট্টো কী করার সিদ্ধান্ত নেন তার ওপর। যদি ইয়াহিয়া নতুন অধিবেশনের তারিখ ঘোষণা করেন এবং তাতে ভুট্টো যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান তবে পাকিস্তানে গুরুতর আঞ্চলিক সমস্যার সৃষ্টি হবে। এই সংঘাত হবে পাঞ্জাব প্রদেশের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট ছোট প্রদেশ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান ও সিন্ধুর মিলিত জোটের যারা পাঞ্জাবের সম্মতি ছাড়াই সংবিধান প্রণয়ন করতে পারবেন।

কিন্তু চূড়ান্ত বিশ্লেষণে এটা বের করা কঠিন যে শেখ মুজিবুর রহমান এবং মি. ভুট্টো আইনসভায় তাদের পার্থক্য কীভাবে ঘোচাবেন এবং উভয় পাকিস্তানে গৃহীত একটি সংবিধান কীভাবে প্রণয়ন করবেন। বিশ্বে অর্জিত ইতিবাচক যা ভাবমূর্তি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আছে তাকে সঙ্গী করেও ইয়াহিয়ার পে এরকম কোনো সংবিধান অনুমোদন করা সম্ভব নয় যা ভুট্টোর কাছে, পাঞ্জাবের কাছে ও সেনাবাহিনীর কাছে অগ্রহণযোগ্য। বাঙালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারভিত্তিক কোনো সংবিধান অনুমোদন করতে প্রেসিডেন্ট যদি ব্যর্থ হন তবে তবে শেখের পক্ষে ঘোষণা দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না যে পশ্চিমাংশ পুরো পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং প্রদেশ দু-টি চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।

পাকিস্তান ভাঙ্গনের মুখোমুখি

দি টাইমস, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১

পিটার হ্যাজেলহার্স্ট

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

দিল্লি, ২৭ ফেব্রুয়ারি। পশ্চিম পাকিস্তানের ও পিপলস্ পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো প্রথমবারের মতো জনঅংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বয়কট করার ফলে মীমাংসার আর কোনো পথ খোলা রইলো না। সত্যিকারের বিপদ এখন দেখা গিয়েছে। ভুট্টো ও পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান অধিবেশন বসার ১২০ দিনের মধ্যে পরস্পরের কাছে সমর্থনযোগ্য ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মাধ্যমে অনুমোদিত একটি সংবিধান প্রণয়ন করবেন বলে কথা ছিল। তেমনটি ঘটার সম্ভাবনা কমই ছিল, কিন্তু এখন যেটা দাঁড়ালো তাতে, তেমন হবার আশা অপসৃত হলো।

এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে যতক্ষণ না প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দুই নেতার মধ্যে অধিবেশন বসার তারিখ ৩ মার্চের মধ্যে মধ্যস্থতা করার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করছেন, পাকিস্তানে একটি ব্যাপক আকারের বিচ্ছিন্নতা-আন্দোলন শুরু হবার হুমকির মুখে পড়ছে। কিন্তু সমঝোতা হবার আর কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হচ্ছে না। পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিব ও তার আওয়ামী লীগ চাচ্ছে ভুট্টো ও তার পিপলস্ পার্টিকে সহ অথবা ছাড়াই অধিবেশন আহ্বান করতে। ৩১৩টি আসনের মধ্যকার ১৬৭ আসনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ নিজেরাই তাদের প্রস্তাবিত চূড়ান্ত-স্বায়ত্তশাসনের সংবিধান পাশ করাতে সম। তাদের প্রস্তাব অনুসারে কেন্দ্রীয় সরকার দুর্বল হবে এবং তার হাতে কেবল তিনটি দায়িত্ব থাকবে: প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা।

অন্যদিকে ভুট্টো কার্যকর কেন্দ্রীয় সরকার চান। বাঙালিরা যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে তাদের সাংবিধানিক প্রস্তাবনা পাশ করিয়ে নেয়, তবে সেটা পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। এমনকি ভুট্টো যদি সংবিধান প্রণয়নে অংশগ্রহণও করেন তারপরও সন্দেহ থেকে যায় যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এমন কোনো সংবিধান অনুমোদন করবেন বা পারবেন যা বাঙালিদের চাপে প্রণীত হয়েছে। অধিবেশন বয়কট সম্পর্কিত ব্যাখ্যা দেবার সময় ভুট্টো এই শংকার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। এসপ্তাহের প্রথম দিকে তিনি পাকিস্তান রেডিওকে বলেছিলেন তিনি সত্যিকার অর্থে সংবিধান প্রণয়ন করতে যাচ্ছেন না … তিনি ঢাকায় যেতে পারেন কেবল এই শর্তে যে বাঙালিরা তাদের চূড়ান্ত স্বায়ত্তশাসনভিত্তিক ছয় দফার ব্যাপারে আপস করবে।

কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে পারস্পরিক মিলিত হবার কোনো সম্ভাবনা আর দেখা যাচ্ছে না। শেখ মুজিবুর রহমান বলছেন এবং বলতে থাকবেন যে পাকিস্তানকে যদি একক দেশ হিসেবে টিকিয়ে রাখতে হয় তবে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছার ওপরে ভিত্তি করেই সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। তিনি তার ছয়দফা কর্মসূচীর ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। রাজস্ব ও বৈদেশিক বাণিজ্য কি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতেই থাকবে, না তা প্রাদেশিক সরকারের হাতে যাবে — দুই নেতার মধ্যে সত্যিকারের বিরোধ সেবিষয়েই।

মি. ভুট্টোর জনপ্রিয়তা ভারত-বিরোধী অবস্থানের কারণেই। তিনি চান রাজস্বের ব্যাপারটি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতেই থাকবে যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে একটি শক্তিশালী প্রতিরা-ব্যবস্থা থাকে। শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পারেন না তার প্রদেশ কেন ১২০০ মাইল দূরে অবস্থিত কাশ্মিরীদের জন্য প্রতিরা বাজেটের অর্ধেক অংশে অবদান রাখবে। কাশ্মির নিয়ে দিল্লির সঙ্গে পাঞ্জাবের বিরোধের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য বন্ধ করে দেবার অধিকার পশ্চিম পাকিস্তানের আছে কিনা সেবিষয়েও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন।

এমাসের প্রথম দিকে এক সভায় দু-নেতা জনসম্মুখে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে এই দুই দফায় তাদের মতৈক্য হয় নি এবং ফলে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় তা মি. ভুট্টোকে অধিবেশন বয়কটের সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দেয়। মনে করা হচ্ছে শেখ মুজিবুর অবশ্যই নির্ধারিত ৩ মার্চেই অধিবেশন বসতে হবে। যদি সামান্য কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী সংবিধান প্রণয়নে কাজ করেন তবে যেকোনো অর্থেই পূর্ব পাকিস্তানের ইচ্ছা অনুসারেই সংবিধান প্রণীত হবে।

এই পরিস্থিতিতে, এটা আশা করা হচ্ছে যে প্রেসিডেন্ট সংবিধান অনুমোদন করবেন না এবং হয় শেখ মুজিবুর রহমান অথবা ভুট্টো এককভাবেই স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন।

বাংলার সঙ্কটকাল

দি টাইমস, ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেবেন এবং স্বায়ত্তশাসন প্রসঙ্গে তার অবস্থান তিনি পরিবর্তন করতে পারবেন না। তার দলে এবং তার বামের দলগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চিম থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হবার দাবি প্রতি ঘণ্টায় আরও জোরালো হয়ে উঠছে। পূর্ব পাকিস্তানকে সারা বিশ্বের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে, কিন্তু জনগণ ও বিক্ষোভকারীদের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সেই শাসকের প্রতীকে পরিণত হয়েছে যাদের তারা ছুঁড়ে ফেলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই সেনাবাহিনীর এক তৃতীয়াংশ ও পুরো পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা হলো বাঙালি; তাই করাচির পে বেশিদিন মতা ধরে রাখা সম্ভব হবে না, ক্ষমতাবৃদ্ধির জন্য সামনের সময়ে যাই করা হোক না কেন। এরপরও এখন পর্যন্ত এটা নিশ্চিত নয় যে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে।

এখনও এরকম একটি সম্ভাবনা আছে যে শেখ মুজিবুর রহমান দু-টি পৃথক আঞ্চলিক সংবিধান তৈরীর আহ্বান জানাতে সমর্থ হবেন, যেখানে প্রতিটি অংশই কেন্দ্রীয় সার্বভৌম কেন্দ্রীয় কর্তৃপরে বিধান পরিত্যাগ করবে এবং যার শাসনপ্রণালী ও শাসনএলাকা আলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে ঠিক করা হবে। শেখ মুজিব তার দলকে গ্রহণ করতে বা গ্রহণ করানোর চেষ্টা করতে বড়জোর এইটুকুই করতে পারেন। ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩১৩ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পেয়েছে। কিন্তু ঢাকায় যাবার ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানিয়ে মি. ভুট্টো জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে প্রভাবিত করেন। এই ব্যাপারটি আওয়ামী লীগ ও বাঙালিদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে।

বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনার পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে ভারত-বিরোধী মনোভাব তৈরী হবার পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ভুট্টোর অবস্থান সুসংহত হয়। পূর্ব পাকিস্তানীরা দেখলো নির্বাচনে হারার পরও পশ্চিম পাকিস্তানীরা মতা দখল করে রাখতে চাচ্ছে এবং নির্বাচন-পরবর্তী আলোচনায় পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবি মেনে নিচ্ছে না। তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব বছরের পর বছর ধরে বেড়ে উঠেছে। বিগত বন্যায় করাচির অমনোযোগিতার পর ডিসেম্বরের নির্বাচনে তার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় নিশ্চিতভাবেই চান না যে ইতিহাস তাকে তেমন মুসলিম নেতা হিসেবে চিহ্নিত করুক যিনি পাকিস্তানকে ভেঙ্গে দু-টুকরা করেছেন। মি. ভুট্টোই তাকে সেই দিকে ঠেলে দিয়েছেন। তার হাত যদি শক্ত হয়েই থাকে এবং বিভক্তি যদি পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে না হয়ে থাকে তবে ভারত ও পাকিস্তান কঠোর সমস্যার সম্মুখিন হবে। পূর্ব পাকিস্তানে যখন ওলটপালট ঘটে চলেছে তখন পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন হতে যাচ্ছে যেখানে সমাজতান্ত্রিক সরকার গঠিত হবার জোর সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের পুরোমাত্রার ‘বাংলাদেশ’-রাষ্ট্রের দাবিকে এখন পর্যন্ত অবাস্তব বলেই মনে হচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে বিরোধিতা করে যে সহিংসতা ও উত্তেজনা চালু রয়েছে তার পাল্টা জবাব হিসেবে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপরে আঘাত আসতে পারে। আবার দুই বঙ্গের মধ্যে ভাষা, সাহিত্য ও ইতিহাসের ভিত্তিতে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে যা নয়া দিল্লিকে চিন্তিত করে তুলতে পারে।

যে-মুসলিম লীগের মাধ্যমে পাকিস্তানের স্বাধীনতা এসেছিল, আওয়ামী লীগ হলো পূর্ব পাকিস্তানে মৃতপ্রায় সেই মুসলিম লীগেরই উত্তরসুরী। দৃষ্টিভঙ্গীর দিক থেকে আওয়ামী লীগ জাতীয়তাবাদী ও আঞ্চলিক। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী মুসলিম লীগ হলো নিষিদ্ধ পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির বিকল্প একটি মাওবাদী সংগঠন — ছাত্র, ট্রেড ইউনিয়ন ও কৃষকদের মধ্যে যার কর্মকাণ্ড বিস্তৃত। সীমান্তের অপর পাশে, কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্কসবাদী) নির্বাচনে জিততে যাচ্ছে। মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া নকশাল জঙ্গীদের সঙ্গে একত্রে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে যাতে নির্বাচনে একটি কমিউনিস্ট-বিজয় নিশ্চিত হয়। মস্কোপন্থী অংশটি ব্যাপকভাবে অকার্যকর। উভয় বাংলায় একই ধরনের পদেক্ষেপের উদ্দেশ্য হাসিল করতে গিয়ে আসলে একটি সাধারণ হতাশা ও স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে (অবশ্য শিল্প ও উন্নয়মূলক পদক্ষেপ যা কিছু দেখা যাচ্ছে তা ভারতীয় অংশেই হচ্ছে)।

মিসেস গান্ধী ভারতের আঞ্চলিকতাবাদ ও সমন্বয়হীনতার প্রবণতাকে উল্টে দিতে সমর্থ হতে পারেন। এছাড়া চীন বাংলা-পরিস্থিতির সুবিধা নিতে পারে, যদিও পিকিং দৃশ্যপট থেকে দূরেই রয়েছে বলে মনে হতে পারে। কোন পাকিস্তান চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবে সেটা একটা প্রশ্ন। পূর্ব পাকিস্তান মনোভঙ্গির দিক থেকে অনেক কিছুই মেনে নিতে চাইবে, বিশেষত ভারতের কাছ থেকে সাহায্য নিলে (ভারতের পেছনে থাকবে সোভিয়েত ইউনিয়ন), কাশ্মির বিষয়ক ঝগড়ায় নিজেকে প্রত্যহার করে নেবে। আবার বিভক্ত পাকিস্তানেও, একটি অংশ কাশ্মির নিয়ে চীনের সঙ্গে সহযোগিতা করবে এবং অন্য অংশটি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পৃথক থাকার জন্য চীনের সঙ্গে সহযোগিতা করবে। ভারতের জন্য, ভারতীয় মহাসাগর এলাকার জন্য, রাশিয়া ও চীনের মধ্যে প্রতিযোগিতার জন্য, বাংলার সমস্যা সত্যিই গুরুতর।

পাকিস্তানে সহিংসতা ও বিচ্ছিন্নতার দৃশ্যপট

দি টাইমস, ১৫ জানুয়ারি, ১৯৭১

পিটার হ্যাজেলহার্স্ট

অনুবাদ:
ফাহমিদুল হক

”পাকিস্তানের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে আজ দেশটি সবচাইতে বিপজ্জনক ও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি”

১২০০ মাইলের ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও কিন্তু ইসলামী ঐক্যের মাধ্যমে যুক্ত পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ব বাংলার ভূখণ্ডদ্বয় ২৩ বছর পূর্বে একটি একক পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। দু-অংশের স্পর্শকাতর সম্পর্ক গত দু-দশকে উন্নতির চাইতে অবনতিই বেশি হয়েছে। পাকিস্তানের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে আজ দেশটি সবচাইতে বিপজ্জনক ও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। কারণ দেশটির দু-প্রদেশের নবনির্বাচিত নেতাদ্বয় পরস্পরের কাছে গ্রহণযোগ্য সংবিধানের রূপরেখা প্রণয়ণের জন্য মিলিত হচ্ছেন।

পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ ভাগ্য নির্ভর করছে তিনজন ব্যক্তির ওপরে: পূর্ব পাকিস্তানের অনলবর্ষী জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান; প্রখ্যাত আইনজীবী ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রি জুলফিকার আলি ভুট্টো, যিনি পশ্চিম পাকিস্তানের মুকুটহীন সম্রাট; এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, যাকে সংবিধান প্রণয়ণের কাজটি সারতে হবে। ভুট্টো এবং মুজিব উভয় নেতাই ১৩ কোটি পাকিস্তানীকে নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন যে সংবিধান প্রণয়ণের ব্যাপারে তারা একটি আপস-মীমাংসায় পৌঁছবেন, কিন্তু সংবিধানের মৌলিক কাঠামো নিয়ে তারা পরস্পর-বিরোধী অবস্থাই গ্রহণ করেছেন। সত্যিকার অর্থে উভয় নেতাই মনে করেন আপস করলে করতে হবে উনাকে এবং তার নিজের প্রত্যাশামতো সংবিধান প্রণীত হবে। শেখ মুজিব এমন একটি সংবিধান চান যার কারণে পাকিস্তান শিথিল ফেডারেশনের পাঁচটি রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যাবে এবং প্রাদেশিক সরকারগুলো এমন স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে যার মাত্র স্বাধীনতার চেয়ে সামান্য কম। যদি শেখের মতো করে সব কিছু হয় তবে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা-ব্যবস্থা ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে আর কিছুই থাকবে না।

অন্যদিকে মি. ভুট্টো কার্যকর কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে যার হাতে অর্থনৈতিক বিষয়াবলী ও রাজস্বসংক্রান্ত সবকিছুসহ প্রধান সবকিছুই থাকবে। দুই নেতাকে অনেক কিছুতেই একমত হতে হবে, কিন্তু সংবিধান প্রণয়ণ করতে চাইলে দুটি বিষয়ে একমত হতে হবে: বৈদেশিক বাণিজ্য ও রাজস্ব কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে না প্রাদেশিক সরকারের হাতে? এই দুই বিষয়ে যদি দুই নেতার আপসের কোনো সুযোগ থাকে তবে সেটা ছোটই; দুই ইস্যুর পেছনেই রয়েছে ইন্দো-পাকিস্তান সম্পর্ক ও কাশ্মির-প্রসঙ্গে উভয় নেতার আবেগগত ও পরস্পরবিরোধী অবস্থান। এছাড়া, উভয় নেতাই জানেন যে রাজস্ব অথবা বৈদেশিক বাণিজ্যে যদি তারা বড়ো ছাড় দেন তবে নিজ নিজ রাজনৈতিক ক্ষেত্রও ত্যাগ করতে হবে।

এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে ৩১০,০০০ বর্গমাইল এলাকার ৫৭ মিলিয়ন মানুষের পশ্চিম পাকিস্তান বিগত দু-দশকে নাটকীয়ভাবে উন্নতি করেছে; কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া, ৫৫,০০০ বর্গমাইল এলাকার জলাবদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানে ৭৩ মিলিয়ন মানুষ ঠাসাঠাসি করে বাস করে এবং পৃথিবীর অন্যতম পশ্চাদপদ ভূখণ্ড হিসেবে থেকে গিয়েছে। ভুল হোক আর সঠিক হোক, পূর্ব পাকিস্তানীরা বিশ্বাস করে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন ঘটেছে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থ ব্যয় করে। তার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো কাশ্মির নিয়ে ভারতের সঙ্গে সংঘাতের কারণে পশ্চিম পাকিস্তানে অনেক বেশি অর্থ ব্যয়িত হয়ে থাকে। শেখ ও তার সমর্থকরা মনে করেন কাশ্মিরিদের তাদের নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করার অধিকার আছে এবং পূর্ব বাংলা এবিষয়ে আবেগ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে খুবই দূরে অবস্থান করছে। তাই তারা পশ্চিম পাকিস্তানের উত্তর অংশে বিপুল পরিমাণে সেনামোতায়েনের জন্য প্রতিরা বাজেটের শতকরা ৫০ ভাগে কেন অবদান রেখে যাবে তার কেনো কারণ দেখে না (পাকিস্তানের বাজেটের প্রায় অর্ধেক প্রতিরা খাতে ব্যয়িত হয়)।

বৈদেশিক বাণিজ্যের কথাও বলতে হয়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য ১৯৬৫ সালের পর থেকে বন্ধ রয়েছে। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানকে চীন থেকে টনপ্রতি ১৭২ রুপি হারে কয়লা কিনতে হচ্ছে। একই পরিমাণের কয়লা ভারত থেকে কিনলে ৫০ রুপি খরচ হতো। শেখ মুজিব জাতীয় পরিষদে বসলে ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিই সম্ভবত থাকবে তার এবং তার সংবিধানকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে পরিচালিত করতে পারবেন। বৈদেশিক বাণিজ্য ও রাজস্ব বিষয়ে তিনি নিজেকে প্রত্যাহার করবেন কিনা তা নিয়ে ঘোর সন্দেহ রয়েছে। একজন দলীয় কর্মীর মতে: ‘মনে রাখবেন এই ভোট ছিল সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার জন্য ভোট। শেখ মুজিবই কেবল স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতির কারণে স্বাধীনতাকে আটকে রেখেছেন।’ শেখও একইভাবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ: ‘ছয় দফা নিয়ে কোনো আপস নয়।’

কিন্তু ১,২০০ মাইলের ওপারে ভুট্টো বলছেন অন্য কথা: ‘ছয় দফার সবগুলো আমি গ্রহণ করতে পারি না। দেশটি দু-বছরও টিকবে না।’ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রি রাজস্ব ও বিশেষত বাণিজ্য প্রসঙ্গে আপস করবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। মি. ভুট্টো রাজনৈতিকভাবে বিখ্যাত হয়েছেন ভারতের বিরুদ্ধে হাজার বছরের যুদ্ধের প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করার মাধ্যমে। তাসখন্দ চুক্তির পর থেকে তিনিই পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির প্রবক্তা বলে স্বীকৃত। তিনি দৃঢ়ভাবে মনে করেন ভারত-পাকিস্তান-সম্পর্ক ততণ স্বাভাবিক হবে না যতণ না ভারত অন্যান্য প্রান্তিক প্রশ্ন আলোচনার পূর্বে কাশ্মির-বিতর্কের সমাধান করছে। তিনি যথার্থই বলেন, ছয় দফা কাশ্মির বিতর্ককে চিরকালের জন্য ভারতের পক্ষে নিয়ে যাবে। অন্যদিকে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য-সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী এবং কাশ্মির ইস্যুর সমাধান ‘পর্যায়ক্রমে’ করতে চায়।

বেশিরভাগ পাঞ্জাবী মনে করে পূর্ব পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য পুনরায় শুরু করবে এবং বৈদেশিক বাণিজ্য যদি প্রদেশের হাতে যায় তবে ভুট্টোর বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারতের নীতিকেই মেনে নেওয়া হবে। মি. ভুট্টো জানিয়েছেন তিনি ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের বিষয়টি মেনে নেবেন যদি মুজিবুর রহমান কাশ্মির ইস্যুকে একটি জাতীয় ইস্যু হিসেবে মেনে নেন। কিন্তু ব্যাপারটা মুজিবের জন্য স্ববিরোধিতা হবে। কারণ ভুট্টোর কথা মেনে নিলে মুজিবকে পাঞ্জাবে বিপুল পরিমাণে সেনা মোতায়েনে রাজি হতে হবে এবং তার ছয় দফা কর্মসূচীর উদ্দেশ্য তাতে ব্যাহত হবে।

মি. ভুট্টো মনে করেন রাজস্বের বিষয়টি ততটা বড়ো হবে না যদি মুজিব সংবিধানে এরকম একটি ধারা যোগ করতে রাজি হন যা নিশ্চিত করবে যে কেন্দ্রীয় সরকার তার অর্থনৈতিক সমর্থনের জন্য প্রাদেশিক সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরে নির্ভর করতে হবে না। মূলত পশ্চিমা প্রদেশ বিশেষত পাঞ্জাব শেখের রাজস্ব-ফর্মুলার বিরোধিতা করছে। তারা মনে করেন প্রদেশগুলো যদি প্রতিরা খাতে অবদান রাখতে অস্বীকৃতি জানায় তবে কাশ্মির ইস্যুটি মুলতবি রাখা হবে। মুজিবুর রহমানের ফর্মুলা যদি কেন্দ্রের থলেতে অর্থ যোগান না দেয়, তার তত্ত্বানুসারে প্রতিটি প্রদেশের অর্থ ভবিষ্যতে সৈন্যবল বাড়ানোর জন্য তার নিজ প্রদেশেই ব্যয়িত হবে।

এটা সমভাবে সন্দেহজনক যে মি. ভুট্টো এধরনের ফর্মুলা মেনে নিবেন কিনা। এটা অবশ্যই সত্যি যে পাঞ্জাবে তার শক্তিশালী রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে উঠেছে ভারতবিরোধিতার মাধ্যমে, তার সমাজতান্ত্রিক নীতির মাধ্যমে নয়। পশ্চিম পাকিস্তানের এই নতুন নেতা এসব ইস্যুর কোনোটির সঙ্গেই আপস করা কঠিন হবে। একজন কর্মী জানালেন, ‘আমরা পাঞ্জাবীরা কাশ্মির নিয়ে অনেক রক্ত দিয়েছি এবং মি. ভুট্টো যদি কাশ্মির নিয়ে ভারতের কাছে কোনো ছাড় দেন তবে তাকে প্রাণদণ্ড দেয়া হবে।’

পরের ধাক্কাটি হবে সংবিধান কি এককক্ষবিশিষ্ট, না দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। বিদ্যমান কাঠামো অনুসারে সংসদের আসনগুলো জনসংখ্যা অনুসারে প্রদেশগুলোর জন্য বরাদ্দ। এবং এজন্য বৃহৎ জনগোষ্ঠীর পূর্ব পাকিস্তান সংসদে এমনিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে থাকে। স্বভাবতই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সুবাদে পূর্ব পাকিস্তান সংসদে যে সুবিধা পেয়ে থাকে, সেকারণেই তারা এককবিশিষ্ট সংসদ চাইবে। আরেকটি বিষয় অবশ্যই মনে রাখা দরকার, এরকম একটি ধারণা গড়ে উঠছে যে শেখ যদি আপসের জন্য প্রস্তুত না হয়ে থাকেন, তবে পশ্চিম পাকিস্তানীরা দরিদ্র পূর্ব পাকিস্তানীদের ছাড়াই ভালো থাকবে।

সবকিছু নির্ভর করছে এই দুই নেতা তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে রাজনৈতিক ঝুঁকি নিবেন কিনা এবং এইসব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আপস করবেন কিনা। আপাতত সেরকম কোনো সম্ভাবনা নেই। যদি তারা কোনো বোঝাপড়ায় আসতে ব্যর্থ হন তবে, ঘটনাপরম্পরা পর্যবেণ করে এরকম ধরে নেয়া যায় যে পাকিস্তান অবশ্যম্ভাবীরূপে বিচ্ছিন্নতার দিকে এগিয়ে যাবে। যদি পশ্চিমাংশ এবং পূর্বাংশ কোনোটিই ছাড় দিতে রাজি না হয়, এটা খুবই স্বাভাবিক যে উভয়াংশের বৃহত্তর মতৈক্যের ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়ন সম্ভব নয়। এর ফলে মি. ভুট্টোকে সাংবিধানিক সংসদে ‘বিরোধীদলীয় নেতা’ হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করতে হবে। এই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে দুই প্রদেশের মধ্যে সরাসরি সংঘাতই দেখা দেবে এবং সম্পর্কের আরও অবনতি হবে বলে অনুমান করা যায়। ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থ তুলে ধরার মাধ্যমে আরও বড়ো নেতা হয়ে উঠতে পারেন, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে সংসদের মাধ্যমে নিজেদের সংবিধান বের করে নিয়ে আসতে সম।

এবং এর ফল যা দাঁড়াবে তাতে দেশের পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না। বাঙালিরা স্বাভাবিক কারণেই বলবে যে সংবিধান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই রচিত হয়েছে এবং পাশ হয়েছে। পরিভাষাগত দিক থেকে তারা হয়তো ঠিকই বলবে, কিন্তু সংবিধানটি সত্যিকার অর্থে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। ভুট্টোর কথামতো এটা প্রেসিডেন্টকে একটি বেদনাদায়ক দ্বিধার মধ্যে ফেলে দেবে। প্রেসিডেন্টের জন্য এমন কোনো সংবিধান অনুমোদন করা সহজ হবে না যা একটি প্রদেশের পুরোটাই তা প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু মুজিবকৃত কোনো সংবিধান প্রেসিডেন্ট অনুমোদন না করলে তাতে মুজিবের কী প্রতিক্রিয়া হবে তা সহজেই অনুমেয়। বাঙালিরা যুক্তি দেবে যে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত আইনসভা কর্তৃক প্রণীত কোনো সংবিধান পশ্চিম প্রদেশ প্রতিহত করেছে। এই পরিস্থিতিতে মুজিবের কর্মীরা মনে করেন পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সকল প্রকার আপসপ্রচেষ্টা বাতিল করা ছাড়া শেখের আর কোনো বিকল্প নেই। তারা নতুন একটি নির্বাচনে অংশ না নিতেও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

আওয়ামী লীগের একজন কর্মী জানালেন, ‘আরেকটি নির্বাচনের কী মানে? মনে রাখবেন, এই নির্বাচনের মাধ্যমে স্বাধীনতার পে গণরায় দেয়া হয়েছে। আমরা যদি আমাদের স্বায়ত্তশাসন পাই তবে শেখ সাহেব স্বাধীনতা নাও চাইতে পারেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট যদি সংবিধানে সই করতে না চান তবে শেখকে পরের প্লেনেই ঢাকা ফিরে আসতে হবে এবং ফিরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে হবে।’ তিনি জোরালোভাবেই কথাগুলো বললেন। বামপন্থী থেকে ডানপন্থী, কৃষক থেকে বুদ্ধিজীবী — পূর্ব পাকিস্তানের সবারই সার্বজনীন মতামত হলো এই। এই অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া কী হয় তার ওপরে। ব্যাপারটি অদৃশ্যমান ও পূর্বানুমানভিত্তিক, কিন্তু এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে সেনাবাহিনী যদি চায় তবে এই পরিস্থিতিতে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করতে পারে। এর মানে হলো ৭৩ মিলিয়ন বাঙালিকেই গ্রেফতার করা, এবং এর ফলে পাকিস্তান ও দক্ষিণ এশিয়া দীর্ঘস্থায়ী সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতায় নিমজ্জিত হবে।

নতুন দু-জন মুকুটহীন রাজা

দি টাইমস, ৯ ডিসেম্বর, ১৯৭০

বিশেষ সংবাদদাতা

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

রাওয়ালাপিন্ডি, ডিসেম্বর ৮:

পাকিস্তানের নতুন দু-জন মুকুটহীন রাজার রাজনীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির এতো বেশি পার্থক্য আছে যে, তারা যে দুই অংশের প্রতিনিধিত্ব করেন তার দূরত্বের চাইতে এই দৃষ্টিভঙ্গির দূরত্ব আরও বেশি। পশ্চিম পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো জন্মেছিলেন লারকানায় ১৯২৮ সালে, একটি বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী সিন্ধি পরিবারে। তার পিতা মরহুম স্যার শাহনেওয়াজ খান ভুট্টো বোম্বে সরকারের একজন মন্ত্রী ছিলেন। তিনি ছিলেন ১৯৩০-এর দশকে বোম্বে প্রেসিডেন্সি থেকে সিন্ধুকে পৃথক করার আন্দোলনকারী এডভোকেটদের একজন। তার সন্তানকে উচ্চশিক্ষা প্রদান করা হয়। ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গ্র্যাজুয়েশন করার পরে ভুট্টো অক্সফোর্ডের ক্রাইস্টচার্চ থেকে জুরিসপ্রুডেন্সে এমএ সম্মান শেষ করেন এবং ১৯৫২ সালে তিনি লিংকনস ইন থেকে আইন পাস করেন।

সাউথহ্যাম্পটন ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে কিছুকাল কাজ করার পর তিনি পাকিস্তানে আইনব্যবসার মাধ্যমে জনজীবনে অনুপ্রবেশ করেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের বিপ্লবী সরকারে তিনি বাণিজ্যমন্ত্রিত্বে নিয়োগ পান। পরে তিনি কাশ্মিরবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রি হিসেবে দায়িত্ব পান; কিন্তু তার আগেই তিনি আন্তর্জাতিকভাবে কাশ্মিরবিষয়ক একজন গুরুত্বপূর্ণ, নির্ভরযোগ্য বিশেষজ্ঞ ও বক্তা হিসেবে আবির্ভূত হন।

তরুণ আইনজীবী তার অফিসের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নির্মাণের জন্য কাজ করা শুরু করেন এবং এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে বর্তমানে চীন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির ঘোর সমর্থক। সুশিতি ও শিষ্টাচারী ভুট্টো ভারতের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে ওকালতী করেন। তিনি তীব্রভাবে আমেরিকাবিরোধী এবং তিনি চান পাকিস্তান চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হোক। অভ্যন্তরীন ক্ষেত্রে তিনি জোরালোভাবে ক্ষমতাধর কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষপাতী এবং বলে থাকেন যে মতায় গেলে তিনি ইসলামী সমাজতন্ত্র কায়েম করবেন।

‘বাংলার বাঘ’ শেখ মুজিবুর রহমান একটি মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে বড়ো হয়েছেন এবং বিক্ষুব্ধ বাংলার রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে তিনি পড়াশুনা করেছেন। এই ৪৮-বছর-বয়েসী নেতা কলেজে ১৯৩৯ সালে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেন এবং তখন থেকে তার জীবনের বেশিরভাগ সময় জেলে ও জেলের বাইরে কাটিয়েছেন। ১৯৪৬ সালে তিনি প্রথম বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হন। কিন্তু দু-বছর পর রাষ্ট্রভাষা-বাংলা-দাবির আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে তিনি জেলে বন্দি হন। ১৯৬৪ সালে তিনি প্রাদেশিক সরকারে মন্ত্রী হন, কিন্তু এই অনলবর্ষী নেতা কয়েকমাস বাদেই আবার জেলে প্রেরিত হন। তাকে আরেকটি মন্ত্রিত্বের পদ দেয়া হয়, কিন্তু ১৯৫৭ সালে গণ-রাজনীতি সংগঠিত করা পরিত্যাগ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি ঝিমিয়ে পড়া পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে চাঙ্গা করেন এবং পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

পরিহাস এই, দু-বছর আগে যে-লোকটিকে একজন বিশ্বাসঘাতক বলা হয়েছিল, তিনিই এখন পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রি হবার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ব্যক্তি। তিনি যদি তা হতে পারেন তবে অবশ্যই দিল্লির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলবেন। তিনি অবশ্যই পশ্চিমাপন্থী কিন্তু পাকিস্তানকে সিয়াটো ও সেন্টো থেকে প্রত্যাহার করতে চান। আপাতভাবে উদীয়মান উভয় নেতার জন্য এটাই সাধারণ মিলের একমাত্র জায়গা।

পাকিস্তানের নির্বাচন মি. ভুট্টোকে পশ্চিমে নেতৃত্ব আনছে এবং পূর্বে শেখ মুজিবুরকে বিজয়ী করছে

দি টাইমস, ৯ ডিসেম্বর, ১৯৭০

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

একটি বিস্ময়কর সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজয়ের মাধ্যমে পকিস্তানের প্রথম অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো পশ্চিমের একক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের মুকুটহীন সম্রাটে পরিণত হয়েছেন। পশ্চিমাংশে নতুন সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে যেখানে ধরা হয়েছিল মি. ভুট্টোর সোশ্যালিস্ট পিপলস পার্টি ৩০টি আসন পাবে, সেখানে তারা পশ্চিমের ১৩৮টি আসনের মধ্যে ৮১টি আসন লাভ করেছে। মি. ভুট্টো ১১৯টি আসনে তার প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিলেন এবং তার দল আশা করছে সবগুলো আসনের ফলাফল প্রকাশ হলে আরো ২০টি আসন লাভ করে শীর্ষে অবস্থান করবে।

পূর্ব প্রদেশে জাতীয়তাবাদী দল আওয়ামী লীগ, যেমন আশা করা হয়েছিল, বাংলার জন্য নির্ধারিত ১৬২টি আসনের মধ্যে ইতোমধ্যেই ১৪৫ আসন লাভ করেছে। এভাবে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের একক বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে, যদিও পশ্চিমের কোনো সমর্থনই তারা পাবে না। একইভাবে ভুট্টোর অনুসারীরা পশ্চিম পাকিস্তানেই সীমাবদ্ধ, পূর্বে সমর্থনের কোনো আশা বা চেষ্টা তারা করেনি।

এই দু’জন আঞ্চলিক নেতা পকিস্তানের সব ইস্যুতে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করে থাকেন এবং নির্বাচনের এই ফলাফল পকিস্তানকে সম্পূর্ণ দু’টি পৃথক রাজ্যে বিভক্ত করে ফেলবে বলে মনে হচ্ছে। মি. ভুট্টো ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র’র ব্যানারে তার নির্বাচনী প্রচারাভিযান চালিয়েছেন, ভারতের সঙ্গে এক হাজার বছরের যুদ্ধ করার প্রতিজ্ঞা করেছেন এবং পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে বেশিরভাগ আসন পেয়েছেন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশেও তিনি সমর্থন অর্জন করতে পেরেছেন।

প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে চূড়ান্ত ফলাফল আসছে এবং এটা পরিস্কার যে ভুট্টো পাঞ্জাবের ৮২টি আসনের মধ্যে অন্তঃত ৬২টি আসন পাবেন এবং নিজ প্রদেশ সিন্ধুতে ২৭টি আসনের মধ্যে ১৯টি আসন পাবেন। এছাড়া তিনি নিজে যে-ছয়টি আসনে দাঁড়িয়েছিলেন তার পাঁচটিতেই তিনি জিতছেন। যে কাউন্সিল মুসলিম লীগকে ভাবা হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে, মিয়া মুমতাজ দৌলতানার সেই দলটির ভরাডুবি হয়েছে। যে ৫০টি আসনে তারা প্রতিযোগিতা করেছিল তার মধ্যে তারা মাত্র ৭টি আসন পাচ্ছে। বিস্ময়করভাবে ডানপন্থী কট্টর দল জামাত-ই-ইসলামী খুবই খারাপ ফলাফল করেছে এবং বাম ধারার ধার্মিকের দল হাজারভি জামাত উলামা ইতোমধ্যেই পাঁচটি আসন লাভ করেছে।

নির্বাচনে অংশ নেয়া অন্যান্য ২৩টি দলের প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। কিছু বিখ্যাত নেতা তাদের নিজস্ব নেতৃইমেজের কারণে নিজ নিজ এলাকায় জয়লাভ করেছেন। এদের মধ্যে আছেন পাকিস্তান গণতন্ত্রী দলের বিখ্যাত নেতা নূরুল আমিন, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মিয়া মুমতাজ দৌলতানা ও আব্দুল ওয়ালি খান। তবে বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল আসগর খান, যিনি আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সংঘটিত গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, পিপলস পার্টির প্রার্থী হিসেবে রাওয়ালাপিন্ডিতে পরাজিত হন।

এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে ক্ষমতাবান আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করেছে। দলটির জনপ্রিয়তা দাঁড়িয়ে আছে প্রধানত তার পশ্চিম পাকিস্তান বিরোধী অবস্থান এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসনের প্রতিজ্ঞা থেকে। তবে এখানে একটি ব্যাপার ছিল যে, আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী পিকিংপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি শেষ মুহূর্তে নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয় এবং এভাবে শেখ মুজিবের মাঠ ফাঁকা হয়ে যায়। দলটি এখন গত সপ্তাহে বাতিল হয়ে যাওয়া ঘুর্ণিঝড়-দূর্গত বাকি নয়টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে।

রাওয়ালাপিন্ডি, করাচি, পেশওয়ার ও পাঞ্জাবের গ্রামাঞ্চলে কিছু বিচ্ছিন্ন সংঘাতের ঘটনা ছাড়া নির্বাচন সহিংসতা ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচন এক অর্থে পাকিস্তানে উত্তেজনা কমিয়ে দিয়েছে কিন্তু অন্য অর্থে দেশটিতে জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

পাকিস্তানের নতুন রাজনৈতিক প্রতিনিধিবর্গকে জাতীয় পরিষদে প্রথম দিন বসার পর থেকে ১২০ দিন সময় দেয়া হবে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করার জন্য। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল ও সাংবিধানিক সংসদের চেহারা যা দাঁড়াচ্ছে তা থেকে মনে হচ্ছে সে-প্রক্রিয়া থেমে যাবে। পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২ জন প্রতিনিধি এরকম একটি সংবিধানের জন্য লড়াই করবেন যা প্রদেশগুলোর সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসন দেবে। শেখ মুজিব যদি সংসদে তার দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন তবে কেন্দ্রীয় সরকারকে তার প্রতিরা ও পররাষ্ট্র ছাড়া সব ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে।

তিনি এরকম একটি সংবিধান চাচ্ছেন যা বাঙালিদের তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য নিজস্ব পছন্দকে যাচাই করার সুযোগ নিশ্চিত করবে। এর ফলে পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারবে। অন্যদিকে ভুট্টো ক্ষমতাধর কেন্দ্রীয় সরকার সমর্থন করেন এবং তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বেশিরভাগ দাবিরই বিরোধিতা করবেন। তাই দুই নেতা সমঝোতায় আসতে পারবেন কিনা সেব্যাপারে সন্দেহ থেকে যাচ্ছে।

তারা ইদানীং দাড়িওয়ালাদের দেখে নিচ্ছে

দি অবজারভার, ৫ ডিসেম্বর, ১৯৭০

গ্যাভিন ইয়াং

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

করাচি, ৫ ডিসেম্বর:

রাস্তা-ঘাটে লাউডস্পিকার-ভ্যান থেকে দীর্ঘ বক্তৃতা শুনতে পাবেন, সংবাদপত্রে রাজনৈতিক অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ আপনাকে সন্ত্রস্ত করে তুলবে। সেনাবাহিনী রয়েছে সহিংসতা রোধ করার জন্য। সোমবার ছিল পাকিস্তানের ইতিহাসে স্মরণীয় একটি দিন; ২৩ বছরের মধ্যে প্রথম ৫৬ মিলিয়ন ভোটারে জন্য সাধারণ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং এ-নির্বাচনই নির্ধারণ করবে সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় থাকবে কি থাকবে না। এটা সম্ভবত তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান পৃথক হয়ে যাবে কি না, যদিও এটা নির্ভর করছে বাংলার অনলবর্ষী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর; তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের দ্বারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হবার মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতার ইঙ্গিত দিয়েছেন।

পাকিস্তানের বামেরা লড়াইয়ের পথে আছে। লাহোরের ওল্ড গার্ডেন সিটির একটি প্রাসাদোপম বাড়ির একটি লম্বা ডাইনিং টেবিলে একজন পাঞ্জাবী মিলিওনিয়ার ও একজন উদীয়মান আইনজীবীর (যিনি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর পক্ষে শহরে সাধারণ নির্বাচনী প্রচারাভিযান চালাচ্ছেন) সঙ্গে বসে ছিলাম। মিলিওনারটি এতো ধনী যে তাকে কাজ করতে হয় না, যদিও তারা দু’জনেই কেমব্রিজে ছিলেন। তারা ক্লান্ত হাতে খাবার তুলে নিলেন; এইমাত্র তারা তাদের পেছনে একের পর এক দাঁড়িয়ে থাকা চাকরদের কাছে বামপন্থী লিফলেট বিতরণ করেছেন। খাবার মুখে নিয়ে তমিজের সঙ্গে চিবুতে থাকা তরুণ মিলিওনিয়ারটি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির একজন নেতা, যে-দলটি ভুট্টোর বামপন্থী দলের চাইতে বেশি বামপন্থী। ভুট্টোর সঙ্গে দলটির পার্থক্য কী? ক্লান্ত চোখের ওপর ক্লান্ত চোখের পাতা ফেলে তিনি বলেন, ‘কিছু অদ্ভূত কারণে ভুট্টো সুকর্নর ভক্ত। আমরা অবশ্য মাও সে তুং-এর অনুসারী।’

তিনি শান্তভাবে একটি লম্বা হোল্ডারে সিগারেট নেভালেন। ‘ভুট্টো মুসলমানদের নিয়ে খেলছেন বলে মনে হচ্ছে।’ তিনি আইনজীবীর দিকে তাকিয়ে বলরেন, ‘শ্রমিকরা এখন কাঁচা-পাকা দাড়িওয়ালা মৌলভীদের দেখে নিচ্ছে, আপনি হয়তো লক্ষ করেননি।’ আইনজীবী উত্তর দিলেন যে, পাকিস্তান এখনও খুবই সনাতনপন্থী ধর্মীয় দেশ — একই ধর্ম পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তনের মধ্যকার সংযোগ সেতু — ইসলাম ও সমাজতন্ত্র ব্যবহার একটি যৌক্তিক কৌশল। মূলস্রোতের বাইরে এ-ধরনের পরিস্থিতিতে বামপন্থীদের ভোটাররা অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে; পরবর্তী কয়েকটি সপ্তাহে তারা শুধু এটাই জানবে যে তারা কী পেয়েছে।

বাম হলো অদ্ভূত এক জিনিস, অপ্রচলিতভাবে নানারঙা ও বহুধাবিভক্ত, এটা মাওবাদ থেকে সুকর্ণবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত এবং শেষে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে ফিরে আসে। এর নেতাদের বেশিরভাগই সচ্ছল। কেউই শ্রমজীবী শ্রেণীর নয়। ডান ও কেন্দ্রের ইসলামপন্থী-দল-বিরোধী বামপন্থী-তারকারা শেষ সময়ে সক্রিয় — মুজিব পূর্বে বিজয়ের অপেক্ষা করছেন, ভুট্টো পশ্চিমে সনাতনপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। এদিকে মুজিবের মিটিংয়ে লাখ লাখ মানুষ জয়ের জন্য একত্রিত হচ্ছে; ভুট্টো একই সঙ্গে পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, নির্বাচনী আইন তাকে সে সুযোগ দেয়।

মুজিবের সমস্যা কীভাবে জয়ী হতে হবে, তা নয়, জয়ের পর তিনি কী করবেন সেটাই হলো সমস্যা। তার আন্দোলন তাকে ছয় দফা অনুসারে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বাস্তবায়নের কথা বলে। ছয় দফা অনুসারে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে প্রতিরা ও পররাষ্ট্র থাকবে কিন্তু রাজস্ব গ্রহণের মতা কেন্দ্র হারাবে। এটা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মতো মিলিটারি-ব্যক্তিত্ব, যিনি জাঁদরেল কিন্তু বেকুব নন, মেনে নেবেন না। রাজনৈতিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানীরা অবিশ্বাস করলেও ভারতের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হিসেবে তাদের অনুমোদন করে; তারাও কাউকে তাদের বাজেট নিয়ে পরীক্ষঅ-নিরীক্ষা করতে দেবে না। নব-নির্বাচিত আইনপরিষদ যখন নতুন একটি সংবিধান প্রবর্তন করতে যাবে তখন মুজিব ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘাত বাধার সম্ভাবনা রয়েছে। সংবিধানটি অনুমোদন না করা পর্যন্ত সেনাবাহিনী মতা পরিত্যাগ করবে না।

পূর্বের এই উদীয়মান তারকা একজন অপ্রতিরোধ্য, তীব্রভাষী, অন্তপ্রাণ রাজনীতিবিদ — যার ভরাট কণ্ঠ এবং তীব্রভেদী চোখ রয়েছে। ঢাকার তুলনামূলকভাবে সাদামাটা একটি বাড়িতে রমজান মাসে দেখা করতে গেলে তাকে পাইপে তামাক খেতে দেখা যায় এবং খুব গুরুত্ব দিয়ে সব বিষয়ে আলাপ করতে দেখা যায়। তিনি ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স, শিপিং-এর জাতীয়করণের কথা বলেন এবং জানান এতোদিন ধরে পশ্চিম পাকিস্তানের ‘উপনিবেশ’ পূর্ব পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম বাংলার সঙ্গে বাণিজ্য-সম্পর্ক স্থাপন করবে। কেউ জানে না কী ধরনের প্রধানমন্ত্রীত্ব তিনি তৈরী করবেন। তার নানা ধরনের সহকর্মী রয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকে তার চাইতে বামপন্থা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করেন, এবং তাদের দক্ষতাও অনিশ্চিত।

ভুট্টো হলেন একমাত্র ভোটপ্রার্থী যার সত্যিকারের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তিনি সৌজন্যপ্রিয়, বর্ণিল এবং তার মধ্যে অভিজাত্য রয়েছে। তার অনুসারীরা হাস্যোজ্জ্বলভাবে দলীয় ক্যাপ ও পতাকা নিয়ে মিছিল করে। যদিও তার মতা সিন্ধু প্রদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ, কিন্তু তিনি তার সমর্থন বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। তিনি অনেক কিছু করতে পারেন। তিনি ইতোমধ্যে পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে অনুসারী তৈরি করতে পেরেছেন। তিনি একজন রহস্যাবৃত ব্যক্তি। তিনি চাষীদের মধ্যে ভূমি বণ্টন করতে চান — এবং ভূস্বামীদের সনাতন প্রাধান্য খর্ব করতে চান। আজ পাকিস্তানে সম্পদ ও সমাজতন্ত্র পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় অথবা নিজেদের দ্বিধাগ্রস্তভাবে ঐক্যবদ্ধ করে।

আধুনিক ও অসমাপ্ত রাজধানী ইসলামাবাদে আমি ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেণ্ট আইয়ুব খানের সঙ্গে দেখা করি। তিনি তার বাসার লনে রোদে বসে চা খাচ্ছিলেন। তিনি এখন অতীত, ব্যর্থতা, একাকীত্ব ও পরিত্যাজ্যতার প্রতীক। সাবেক বন্ধু ও শুভার্থীরা তাকে পরিত্যাগ করেছে যাদের মধ্যে একজন হলেন ভুট্টো। ভুট্টো এবং পশ্চিম পাকিস্তানী অন্য যেকোনো বামপন্থীর জন্য এবার সত্যিকারের ক্ষমতালাভের সম্ভাবনা নেই। কিন্তু পাশ্চাত্য-বিরোধী মনোভাব এবং পিকিং-য়ের প্রতি সহানুভূতি পাকিস্তানকে বামপন্থীদের জন্য একটি উর্বর ভূমিতে পরিণত করেছে। এরকম একটা বিপদের সম্ভাবনা আছে যে, নির্বাচন-পরবর্তী মতাহীনতা বামপন্থী নেতাদের সবকিছু থেকে অনেক দূরে ঠেলে দেবে। যদি ইয়াহিয়া খানের শক্তিশালী ব্রিগেড আবার মতা দখল করে তবে মুজিব, ভুট্টো এবং অন্যান্য হতাশ নেতৃবৃন্দ বহুলপ্রতিক্ষীত রাজনৈতিক স্বাধীনতা না পেয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদ বা গৃহযুদ্ধ কিংবা উভয়কেই বেছে নেবে।

ঘূর্ণিঝড়-দুর্গতদের এক বছরের সাহায্য প্রয়োজন

দি টাইমস, ২৯ নভেম্বর, ১৯৭০

ম্যক্সওয়েল ব্রেম

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

পাকিস্তানে ঘূর্ণিঝড়ে কি ২০০,০০০ লোক মারা গিয়েছে — যেমন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছেন? অথবা ১০ লাখ — ঘটনাস্থলে উপস্থিতরা যেমন বলছেন? অথবা ২০ লাখ? এসব হল অনুমানের খেলা, যা কোনো কাজে আসে না। বর্তমানে সত্যিকারের প্রশ্ন হলো ত্রাণ বিতরণ এবং বন্যা-উপদ্রুত ব-দ্বীপকে আবার আগের অবস্থায় নিয়ে যাবার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিশ্রম করা যাবে কি না এবং দু’সপ্তাহ আগের দুর্যোগে যারা বেঁচে গিয়েছে তাদের রক্ষা করা যাবে কি না। বেঁচে যাওয়াদের সংখ্যা হবে দুই মিলিয়ন — সংখ্যাটি নির্ভর করছে মৃত্যুর পরিমাণের ওপর। তাদের চোখে এখন অসহায়ত্বের চিহ্ন।

গতকাল বিকেলে আমি হেলিকপ্টার যোগে গত ১২ নভেম্বরের জলোচ্ছ্বাসে আক্রান্ত একটি বৃহত্তম দ্বীপ হাতিয়ায় গিয়েছিলাম। বিরাণ সেই ভূখণ্ডে এখনও গবাদিপশু ও মানুষের মৃতদেহের স্তূপ। এখানে সেখানে জীবিতদের দল গাছের নিচে ভিড় করে আছে। তাদের কেউ কেউ ধাবমান জলের দেয়ালের হাত থেকে বাঁচার জন্য গাছে উঠেছিলো। এর ফলে জীবিতদের মধ্যে নারী ও শিশুদের চাইতে শক্ত-সমর্থ পুরুষদের সংখ্যা বেশি।

আমার হেলিকপ্টারটি ছিলো ফরাসী। ওইতে নামের হেলিকপ্টারটি সৌদি আরব থেকে এসেছে। এটি হলো ব্রিটেনসহ আট জাতির সমন্বিত সাহায্যকারী এয়ার-লিফটের একটি, জীবিতদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য যাদের প্রাথমিক পর্যায়ের ত্রাণকার্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। বহির্বিশ্ব থেকে প্রায় প্রতি ঘণ্টায় প্লেন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় খাবার, কাপড়, পানি পরিশোধক যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে আসছে। পাকিস্তানের সৈন্যরা পাহারা দিয়ে চুরির হাত থেকে সেগুলোকে রা করছে। এয়ারপোর্ট থেকে সেগুলোকে সাধারণত হেলিকপ্টারযোগে সামনের সরবরাহ-ডিপোতে নেয়া হচ্ছে এবং এরপর উপকূল ও বন্যায় ভেসে যাওয়া দ্বীপগুলোতে সেগুলোকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

ব্রিটিশ কমান্ডো হেলিকপ্টারগুলো পটুয়াখালী সাপ্লাই কেন্দ্র থেকে প্রায় ৪,৫০০ টন চাল, তেল, ময়দা, বিস্কুট, চিনি, আলু, গুঁড়ো দুধ এবং কাপড়চোপড় নিয়ে উপদ্রুত অঞ্চলে নিয়ে যাচ্ছে। রেডক্রস ও অন্যান্য সংস্থার লোকজনকে সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে। কারণ, দুর্গতদের কাছে রিলিফ একটু দেরিতে হলেও ঠিকঠাকমতো পৌঁছে যাচ্ছে। রিলিফ বিতরণে এখন আর কোনো দেরি হচ্ছে না এবং রিলিফ সরবরাহেও কোনো ঘাটতি নেই।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার সরকারের ‘ভুল ও বিলম্ব’-এর কথা স্বীকার করেছেন এবং আন্তর্জাতিক সাড়াকে অভূতপূর্ব বর্ণনা করেছেন। তিনি অবশ্য বিদেশী সাহায্যের কতদিন পর্যন্ত প্রয়োজন রয়েছে সে-ব্যাপারে নিরব রয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে অন্তঃত এক বছরের জন্য সাহায্য প্রয়োজন হবে, কারণ সর্বগ্রাসী সমুদ্র ব-দ্বীপের কৃষিজ-ভূমিকে ধ্বংস করে ফেলেছে। পাকিস্তান বিশ্বব্যাংকের কাছে ৭৫ মিলিয়ন পাউন্ডের জরুরি উন্নয়ন প্রস্তাবনা পেশ করেছে। একটি কানাডীয় সংস্থা দ্রুত-জরিপের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারকে ঘূর্ণিঝড়-উপদ্রুত এলাকাকে “স্বাভাবিক” করে তোলার জন্য দু’বছরের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার পরামর্শ দিয়েছে। এটা নিশ্চিত যে আরো বেশি কিছু সময়ের প্রয়োজন হবে। একটি ব্যাপার হল, ৩০ মাইলব্যাপী উপদ্রুত-এলাকায় কোনো বাড়িঘরই দাঁড়িয়ে নেই। দ্বিতীয়ত, ধ্বংসপ্রাপ্ত জমিজমা পূর্বের উৎপাদন-ক্ষমতায় ফিরে যেতে তিন বছর সময় নেবে। ব্যাপক সেচকার্যের প্রয়োজন রয়েছে। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা পুনরায় চালু করতে হবে। এবং কৃষিজ ভূমিকে সমুদ্রের হাত থেকে রা করার জন্য নতুন বাঁধ নির্মাণের বিরাট দায়িত্ব সামনে রয়েছে। মাটি দিয়ে তৈরি ১৬ ফুট উঁচু পুরনো বাঁধ ভেসে গেছে। ডাচ-সরকার দ্রুত ও সহজে বাঁধ নির্মাণের পদ্ধতি বের করার জন্য একটি টিম পাঠাচ্ছে।

এই ধ্বংসযজ্ঞ একটি বড়ো রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে দাঁড়িয়েছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এটা অস্বীকার করা জরুরি হয়ে পড়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত ও ভারত দ্বারা বিভক্ত কেন্দ্রীয় সরকার পূর্বের ধ্বংসলীলা মোকাবেলায় উদাসীনতা ও অবহেলার পরিচয় দিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানীরা বলছে যে, বহির্বিশ্ব থেকে খাদ্য, হেলিকপ্টার ও অর্থ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসার আগেই এসেছে, এবং ৪.৪ মিলিয়ন পাউন্ড ত্রাণের জন্য বরাদ্দ ঘোষণা করতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ১০ দিন সময় লেগেছে। এছাড়া, প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠেছে যে, মৃতদের সৎকারের জন্য পাকিস্তানী সৈন্যদের পরিবর্তে ব্রিটিশ নাবিকদের ব্যবহার করা হয়েছে।

পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ, যে-অংশ পাকিস্তানের ১১০ মিলিয়ন জনগণের মধ্যে পশ্চিমের তুলনায় দরিদ্রতম, এধরনের অভিযোগ এনে পশ্চিম পাকিস্তানের দলগুলোকে বিব্রত করার প্রচারাভিযানে নেমেছে। একটি সাংবিধানিক আইনপরিষদের জন্য পাকিস্তানে এখন থেকে আট দিনের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা। সর্ব-পাকিস্তানী আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা আশি ভাগ ভোট পাবার কথা।

তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে ঘূর্ণিঝড়-দুর্গতদের অবহেলা ও বঞ্চনার জন্য অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। শেখ একজন জাতীয়তাবাদী যিনি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণের জন্য স্বায়ত্তশাসন চান। কেন্দ্রীয় সরকারের এই ব্যর্থতা শেখকে অনেকখানি সাহায্য করতে এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করতে বাধ্য।

গতকাল প্রথমবারের মতো ঢাকায় এরকম পোস্টার দেখা গেছে যাতে বলা রয়েছে, ‘সব নির্বাচিত সদস্যকে অবশ্যই রাওয়ালাপিন্ডি (পশ্চিমের রাজধানী) থেকে নয়, ঢাকা থেকে শাসনকার্যের দাবি করতে হবে’। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মনে হয় এই বিরোধিতার মোকাবেলায় নামবেন। তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন যদি নবনির্বাচিত আইনপরিষদ এমন একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে যা তার ঠিক করে দেয়া মূলনীতর সঙ্গে না মেলে, তবে সামরিক শাসন চলতে থাকবে। মূলনীতিগুলোর একটি হলো পূর্ব পাকিস্তানের শুধু সীমিত স্বায়ত্তশাসন থাকা উচিত।

অনুবাদকের নোট: এই রিপোর্টে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে এতবড়ো একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় পশ্চিম পাকিস্তানী সরকার কতখানি অবহেলা প্রদর্শন করেছে, যেহেতু দুর্যোগটি পূর্ব পাকিস্তানে।

অনুবাদকের বাছাই: “পূর্ব পাকিস্তানীরা বলছে যে, বহির্বিশ্ব থেকে খাদ্য, হেলিকপ্টার ও অর্থ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসার আগেই এসেছে, এবং ৪.৪ মিলিয়ন পাউন্ড ত্রাণের জন্য বরাদ্দ ঘোষণা করতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ১০ দিন সময় লেগেছে। এছাড়া, প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠেছে যে, মৃতদের সৎকারের জন্য পাকিস্তানী সৈন্যদের পরিবর্তে ব্রিটিশ নাবিকদের ব্যবহার করা হয়েছে।”

সমস্যাটা কোথায়?

দি ইকোনমিস্ট, ২৮ নভেম্বর, ১৯৭০

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

১২ ও ১৩ নভেম্বরের সাইক্লোন পাকিস্তানের আবহাওয়াবিদদের অসতর্ক রাখেনি। বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলে ২৫০ মাইল বেগে আঘাত হানার আগের দিন কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও ঢাকার পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ও রাডার স্টেশনগুলো তাদের কাজ করে যাচ্ছিল। আমাদের পাকিস্তান-প্রতিনিধি জানিয়েছেন যে আবহাওয়াবিদরা ১৬ ঘণ্টা পূর্বে ‘হারিকেন ডেঞ্জার’ সতর্কবার্তা এবং তার আট ঘণ্টা পরে ‘হারিকেন গ্রেট ডেঞ্জার’ সতর্কবার্তা ইস্যু করেছিলো। কেউ সেটা শোনেনি কেন? আংশিকভাবে এটা হল সেই বালকের গল্প যে নেকড়ে এসেছে বলে চিৎকার করতো। তিন সপ্তাহ আগে ২৩ অক্টোবরে একই অঞ্চলে কম ক্ষমতাম্পন্ন আরেকটা সাইক্লোন আঘাত করেছিলো। সেসময় রেডিও সম্প্রচার বন্ধ রেখে বারবার সাইক্লোনের পূর্বাভাস জানানো হয়েছিলো এবং উপকূলবর্তী লোকজনকে উঁচু স্থানের সরে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। সেবার সাইক্লোন সীমিত কিছু অঞ্চলে আঘাত হেনেছিলো এবং মাত্র ৩০০ জন মারা গিয়েছিলো। মৃতের হার পূর্ববর্তী বিপর্যয়ের তুলনায় কমই ছিলো। কিন্তু ১২ নভেম্বরে সতর্কবার্তা প্রচার করা সত্ত্বেও গতবার যারা বাড়ি ছেড়ে গিয়েছিলো তারা আবার বাড়ি ছেড়ে যেতে চায়নি।

কিন্তু অফিসিয়াল অসতর্ককতা ও অবহেলাও ছিলো। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ২৫০ মাইল বেগে ঘুর্ণিঝড় ধেয়ে আসার চিত্র পাবার পরে দু’ভাবে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছিলো: সমুদ্রজাহাজের জন্য চালনা সমুদ্রবন্দরে সর্বোচ্চ ১০ নম্বর মহাবিপদসংকেত ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে সর্বোচ্চ ৯ নম্বর মহাবিপদসংকেত এবং জনগণের জন্য একটি বর্ণনা পাঠানো হয়েছিলো। কিন্তু উপকূল থেকে দূরবর্তী দ্বীপসমূহের কাছে সাইক্লোন চলে আসার পর বিপদসংকেত প্রত্যাহার করে নেয়া হয় এই ভেবে যে, জাহাজসমূহ ইতোমধ্যে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে গেছে। সতর্কবার্তা সাধারণ আবহাওয়া-প্রতিবেদনের মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছিল এবং অনুষ্ঠানসমূহ যথারীতি প্রচার হচ্ছিল। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের অনেকেই বিষয়টিকে ততটা ভয়াবহ ভাবেনি।

সাইক্লোনের এমন গতি আগে দেখ যায়নি; দিক পরিবর্তন করে এবং শক্তি সঞ্চয় করে এটি পূর্ববঙ্গের উপকূলে ২৪ ঘণ্টা আগে আঘাত হানে। কিন্তু এই অপ্রত্যাশিত আঘাতের পরেও সাইক্লোনের সঙ্গে ধেয়ে আসা জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা এবং গভীরতা পরিমাপের ব্যর্থতার কোনো ব্যাখ্যা আবহাওয়াবিদরা দেননি। চট্টগ্রামের ভূ-কম্পন-পরিমাপ স্টেশন জলোচ্ছ্বাসের উপরিভাগের রেকর্ড পরিমাপ করতে সমর্থ হয়েছিলো।

পাকিস্তানের একটি হিসেব মতে, যদি জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস দেয়া হতো তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অন্তঃত অর্ধেক কম হতো। জলোচ্ছ্বাসের আঘাতের বারো ঘণ্টা পরে যখন অনেক লোক ইতোমধ্যে মারা গিয়েছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামের আবহাওয়া-বিশারদরা প্লাবিত দ্বীপ হাতিয়া থেকে দুর্যোগের ওয়ারলেস-বর্ণনা বন্ধ করে দেন ‘ফেব্রিকেশন’ হিসেবে। তারা ভুল ধারণা নিয়ে ছিরলন যে, স্বল্প উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস রাত্রি শেষে দেখা যাবে। কিন্তু সত্য হলো পূর্ণিমার কারণে বঙ্গোপসাগরে উঁচু ঢেউয়ের জলোচ্ছ্বাস হয়েছিলো।

এখন সবাই অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে — আবহাওয়াবিদরা প্রাদেশিক সরকারকে, সরকার স্থানীয় এজেন্সিকে এবং স্থানীয় এজেন্সি আবহাওয়া অফিসকে। দায়িত্বে অবহেলা করা সেসব লোকদের কেউ কেউ তাদের দোষ এভাবে ঢাকছিলো যে, সাইক্লোন আঘাত করার আগের ঘণ্টায় তারা অনুপস্থিত থাকার কারণ, সারাদিন রোজা রেখে তারা ইফতারি করতে গিয়েছিলো। সাইক্লোন আঘাতের ২৪ ঘণ্টা পরেই কেবল দুর্যোগের প্রকৃত মাত্রা বোঝা গিয়েছিলো। শনিবার সকালে ঢাকার একটি পত্রিকা লিখল ‘শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়’। ১৪ তারিখেই মৃতের সংখ্যা অনুমানভিত্তিতে বলা হয়েছে ২০০,০০০। কিন্তু মৃতের সংখ্যা সঠিকভাবে ও যাচাই করে ঘোষণা দিতে অনেক সময় লেগেছে। ১৩ তারিখে সরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা বলা হযেছে ৫০ হাজার। তখন থেকে এখন পর্যন্ত সরকারি হিসেব দ্রুত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭৫,০০০-এ। সরকারি হিসেবে ক্রমে সত্যের ছোঁয়া লাগায় পশ্চিম পাকিস্তান এবং সারা বিশ্ব ধীরে ধীরে বুঝতে পারলো কী ধরনের ধ্বংসলীলা চলেছে।

ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রাথমিক সাহয্য ছিলো মাত্র ৩০,০০০ পাউণ্ড। এই পরিমাণ পরে বেড়ে দাঁড়ায় এক মিলিয়ন পাউণ্ডে। একটি প্রকাশিত আবেদনপত্রে আরো এক মিলিয়ন পাউণ্ডের আশা করা হয়েছে যা ব্রিটেনের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল ত্রাণ-উদ্যোগ। লীগ অফ রেডক্রস সোসাইটি এবং জাতিসংঘের কাছে সাহায্যের জন্য পাকিস্তানের আবেদনের পর ভালো সাড়া পাওয়া গিয়েছে — বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের কাছ থেকে। প্রথম সমস্যা ছিলো পূর্ব পাকিস্তানে দ্রুত সাহায্য পাঠানো। সাহায্যের পরিমাণ ভালোই ছিলো; এবং তার বিরাট অংশ ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পৌঁছেছে। কিন্তু আংশিকভাবে সেখানে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছতে অনেক সময় লেগে যায় — ঢাকা এয়ারপোর্টে অবতরণ করতে দেরি হবার কারণে। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ প্রথমে বাণিজ্যিক ফ্লাইটগুলো বাতিল করতে রাজি হয়নি।

জীবিত সব দুর্গতদের জন্য এখন যথেষ্ট পরিমাণ খাবার, কাপড় ও পরিচর্যার সংস্থান ঢাকায় প্রস্তুত রয়েছে। কিন্তু তার খুব সামান্যই গত সপ্তাহের শেষে রেডক্রসের মাধ্যমে দুর্গতদের পৌঁছেছে। ত্রাণসামগ্রী বহনকারী সব প্লেন দ্রুত এয়ারপোর্টে নামতে সরকারকে রাজি করাতে বেশ সময় লেগে যায়। উপদ্রুত ব-দ্বীপে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ একটি বিরাট মাথাব্যথার বিষয়। ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া হাতেগোনা কয়েকটি রাস্তায় এখন নরম পলি জমে আছে এবং জলপথে চলাচলকারী প্রায় সব নৌকাই ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন খুব প্রয়োজন হেলিকপ্টারের এবং ইঞ্জিল-চালিত নৌকার। কিন্তু পাকিস্তান আর্মি বা এয়ারফোর্সের কাছে তা যথেষ্ট আছে বলে মনে হচ্ছে না।

একটি সামরিক সরকারের জন্য এ-ধরনের মহাদুর্যোগে কিছু সুবিধা থাকার কথা। তাদের প্রশিতি যথেষ্ট লোক থাকার কথা এবং তাদের দ্রুতগতির যানবাহন থাকার কথা। কিন্তু সারা সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তানের পাঁচটি ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন শুধু আংশিকভাবে সক্রিয় হয়েছে। যখন নভেম্বরের ১৬ তারিখে সামরিক বাহিনী ত্রাণকার্যের আদেশ পেল, ৫,০০০ লোক জীবিতদের কলেরা এবং টাইফয়েডের প্রতিষেধক দেয়া, মৃতদের কবর দেয়া এবং রাস্তাঘাট পুননির্মাণে নিজেদের নিয়োজিত রাখলো। কিন্তু পাকিস্তান-সেনাবাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসন এবং রেডক্রসের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ছিল। কিছু ব্রিটিশ উদ্ধার-বিমান ঢাকায় কিছু অলস সময় কাটালো, রেডক্রস না সেনাবাহিনী তাদের পরিচালনা করবে এ-বিষয়ে সিদ্ধান্ত না হবার কারণে। এ-সপ্তাহের মঙ্গলবার আর্মিকে একটা বড় মতা দেয়া হলো, রিলিফ কমিশনার হিসেবে একজন বেসামরিক লোককে সরিয়ে একজন সেনাবাহিনীর লোককে সেখানে বসানো হয়েছে। এবার কিছু কাজ হওয়া উচিত।

অনেক লোককে অবাক করেছে যে বিষয়টি, সেটা হল, পাকিস্তান এয়ার-ফোর্সের ২৫টি হেলিকপ্টার থাকা সত্ত্বেও শুধু একটিকে দুর্গতদের ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেবার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। এটা ঠিক যে হেলিকপ্টারগুলোর বেশিরভাগই বেশি ওজন নিতে পারে না। কিন্তু সেগুলো ব্যবহার করলে খুবই কাজে দিত। পূর্ব পাকিস্তানের রিলিফ কমিশনার জানিয়েছেন, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে হেলিকপ্টার আনতে গেলে ভারত তাদের দেশের ওপর দিয়ে উড়ে আসতে সেগুলোকে অনুমতি দিত না। পাকিস্তান-বিমানবাহিনীর বেশিরভাগ স্টেশন পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত। ভারত বলেছে তাদের অনুমতির জন্য কখনোই জিজ্ঞেস করা হয়নি। মূল ব্যাপার হল, যেহেতু পাকিস্তানের হেলিকপ্টারগুলো সামরিক হেলিকপ্টার এবং সেগুলো আসার পথে ভারতে অবতরণ করতে হতো, তাই পাকিস্তান কর্তৃপ সেগুলোকে ত্রাণের কাজে ব্যবহার করতে দিতে চায়নি। এখন ব্রিটিশ হেলিকপ্টার এবং এসল্ট-নৌকাগুলো বঙ্গোপসাগরের জাহাজ থেকে পরিচালিত হচ্ছে, এবং আমেরিকান হেলিকপ্টারগুলো আসতে শুরু করেছে। এবারে হয়তো রিলিফ বিতরণের কাজটি ঠিকঠাকমতো এগুবে। আশার কথা এই যে, বেঁচে যাওয়া হতভাগ্যদের অনেকেই তাদের কাছে রিলিফ পৌঁছার আগে ক্ষুধা, রোগ ও ঠাণ্ডায় মারা যায়নি।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বুধবার দু’দিনের জন্য ঢাকায় এসেছিলেন ব-দ্বীপ অঞ্চলে হেলিকপ্টার-ট্যুর দেবার উদ্দেশ্যে, দু’সপ্তাহ পরের নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে। রাওলাপিন্ডির সরকার এটাকেই ভেবেছেন পূর্ববঙ্গের জন্য যথেষ্ট করা হচ্ছে। সাইকোনের পূর্বে অধিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচনী ইস্যু। এখন পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা সরকারের বিরুদ্ধে ত্রাণ-বিতরণে এবং ‘মানবেতিহাসে বৃহত্তম প্রাকৃতিক-দুর্যোগ মোকাবেলায়’ ব্যর্থতার অভিযোগ তুলেছে। এগারোটি দল নির্বাচন বাতিল করার দাবি জানিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সম্ভাব্য বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনের সময় নিয়ে এখনও কোনো মন্তব্য করেনি। কিন্তু পিকিংপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি তাদের প্রার্থীদের নাম প্রত্যাহারের জন্য বলেছে। নির্বাচন-স্থগিত-হবার-ঘোষণা কিছু দলের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। কারণ, তদের অনেকে খেলাপি হবার জোর সম্ভাবনা আছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে কেউই খুব পরিষ্কারভাবে কিছু ভাবছে না।

খাদ্য, বন্যা এবং দুর্ভিক্ষের দেশ

দি গার্ডিয়ান, ১৬ নভেম্বর, ১৯৭০

কলিম সিদ্দিকী

অনুবাদ: ফাহমিদুল হক

বঙ্গোপসাগরের দিকে ধাবমান নদী গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র সৃষ্ট ব-দ্বীপে ছোট ছোট দ্বীপ ও অসংখ্য খালবিল নিয়ে কলকাতার পূর্ব দিকে দেশটি অবস্থিত। এই নদীমাতৃক দৃশ্যপটে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ তিনটি জিনিস নিয়ে বেঁচে থাকে — বন্যা, খাদ্য ও দুর্ভিক্ষ — তিনটিই সমানভাবে বিখ্যাত। দেশটির বেশিরভাগ অংশ সমতল ও নিচু যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১.৫ থেকে ২.০ ফুট উঁচু।

সমুদ্র সাধারণত গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র থেকে জল গ্রহণ করে। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ সে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, বদ্বীপের উপরিতলটি ভাসিয়ে নেয়। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা হয় ২০ ফুটের মতো, কখনো কখনো এমনকি ৫০ ফুটের মতো। একেকটি জলোচ্ছ্বাস এসে, বিগত জলোচ্ছ্বাসের পর মানুষ যা বিনির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিল, তার সবকিছু ধ্বংস করে ফেলে।

প্রকাশিত

বদ্বীপ অংশটি পূর্ব পাকিস্তানের ৭০ মিলিয়ন লোকের শতকরা ৮০ ভাগ ধারণ করে যেটি হল বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল — প্রতি বর্গমাইলে এখানে ১২০০ লোক বাস করে। বঙ্গোপসাগরের দয়ায় মাত্র তিন থেকে পাঁচ মিলিয়ন লোক এর করাল থাবায় সরাসরি আক্রান্ত হয়। কিন্তু এই জনগোষ্ঠী পৃথিবীর সবচাইতে দরিদ্রদের একটি যেখানে মাথাপিছু আয় মাত্র ২০০ রুপি। (পাকিস্তানের গড় মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ৪১৮ রুপি বা প্রায় ৩০ পাউন্ড যদি সেখানে তুলনামূলকভাবে ধনী পশ্চিম পাকিস্তানকে যোগ করা হয়।)

উদ্ধারকারীরা এবং সরকার সাধারণত এত দেরিতে উপদ্রুত অঞ্চলে পৌঁছে যে জনগণের জন্য তাদের আর তেমন কিছু করার থাকে না। তারা উপদ্রুত এলাকার সমস্যাগুলোকে সমাধান-অযোগ্য মনে করেন, পূর্বের অভিজ্ঞতা মনে করে কাঁধ ঝাঁকান এবং ঢাকা বা ইসলামাবাদে ফিরে যান। আরেকটা জলোচ্ছ্বাস না আসা পর্যন্ত তাদের আর দেখা পাওয়া যায় না। এরপর ফ্যাশন্যাবল একটি সংবাদ শোনা যায় — ‘সাইক্লোনের কারণে সব যোগাযোগ-ব্যবস্থা বিঘ্নিত।’ তারা বড়োজোর এরকম কিছু করতে পারেন যে, হেলিকপ্টার ও বিমানে করে তারা উড়তে থাকবেন, নিচের ধ্বংসলীলা দেখবেন এবং সম্ভবত যেখানে জনমানুষের অস্তিত্ব দেখতে পাবেন সেখানে খাদ্য ফেলবেন। সত্যি কথা হল, এ-অঞ্চলে আধুনিক কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থাই নেই যা বিঘ্নিত হতে পারে। সবচেয়ে ভালো অবস্থায় এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যেতে পরের নৌকাটি পেতে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়।

কর্তৃত্ব

ভূগোল অবশ্য এলাকাটির একমাত্র সমস্যা নয়। ইতিহাস জুড়ে বাংলা হল ভারতীয় মূল ভূখণ্ডে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের সীমান্তভূমি। বাংলা সবসময় দূরবর্তী শাসনকর্তা দ্বারা শাসিত হয়েছে, এবং মজার ব্যাপার হল ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পরে শাসনকর্তারা ইতিহাসের সবচেয়ে দূরবর্তী শাসনকর্তায় পরিগণিত হন।

কিছু পরস্পরবিরোধিতা পরীক্ষা করা যাক। ব্রিটিশরা পাটশিল্প প্রবর্তন করেছিল, কিন্তু দেশবিভাগের কারণে সে মিলগুলো কলকাতায় থেকে গেল। পূর্ব পাকিস্তানে অনেক নতুন জুটমিল স্থাপন করা হয়, কিন্তু সরকার প্রবর্তিত কৃষিজ-পণ্যের মূল্য-নির্ধারণী-নীতি ঢাকা ও চট্টগ্রামের উদ্যোক্তাদের হাতে চাষীদের শোষিত হবার প্রক্রিয়াটি বন্ধ করার ব্যাপারে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। পশ্চিম পাকিস্তানের অপেক্ষাকৃত উন্নত নগর অঞ্চলের শিল্পায়ন উন্নয়নের কাজ হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের পাটনির্ভর অর্থনীতির উদ্বৃত্ত ব্যবহার করে। পূর্ব থেকে পশ্চিমে সম্পদ স্থানান্তরের বার্ষিক পরিমাণ ২৫০ মিলিয়ন রুপি। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে, বিশেষত ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক স্বৈরাচার চালু হবার পর থেকে এ-অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান ক্ষতির পরিমাণ বিশাল।

এই সম্পদের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানে বন্যা-নিয়ন্ত্রণের খরচে কম বরাদ্দ হয়। কয়েক বছর থেকে এ-সমস্যা নিয়ে গবেষণারত বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে ২০টি বহুমুখী প্রকল্প এই সমস্যার বৃহত্তর সমাধান দিতে পারে যার আনুমানিক খরচ হবে ৮০০ মিলিয়ন ডলার।

অর্জন

বিদেশী গাড়ি (প্রধানত জাপানি এবং জার্মানি), রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডশনার, এবং অন্যান্য ভোগ্যপণ্য আমদানি করতে পাকিস্তান যা খরচ করে, তার তুলনায় এই খরচ একটি নতুন পরিপ্রেক্ষিতের জন্ম দেয়। পাকিস্তান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রায় ২০% সুদে ব্যয় করে ৫ বিলিয়ন ডলারের অধিক বিদেশী ঋণের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। যেকোনোভাবেই কোনো দৃঢ়চেতা সরকার অভ্যন্তরীণ মুদ্রা-সম্পদের সমস্যায় পড়তে পারে না। এসব কারণে বিশ্বব্যাংক প্রস্তাবিত বাঁধ বা খাল নির্মাণকর্ম নাও করা যেতে পারে, যদিও কোনো বৈদেশিক সাহায্য ছাড়াই একটি বাঁধ-ব্যবস্থা বিপর্যয়ের মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে। এটা ইচ্ছার ব্যর্থতা, অর্থের নয়। কিন্তু বিশ্বব্যাংক প্রয়োজনীয় ৮০০ মিলিয়ন ডলার দেবে না; কারণ মৃত্যু ও ধ্বংসের এই মাত্রা একটি রাজনৈতিক ইস্যু নয়। সিন্ধুর পানি নিয়ে ভারত-পাকিস্তান বৈরিতা নিয়ে বিশ্বব্যাংক এবং পশ্চিমা শক্তিগুলো অবশ্য ‘শান্তিরক্ষায় এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ’ করেছিল।

তবে এখন কিছু নিদর্শন দেখা যাচ্ছে, যাতে বোঝা যাচ্ছে যে, বর্তমান সরকার সমস্যাগুলোকে একটু গুরুত্বসহকারে দেখছে। প্রত্যেক বক্তৃতায় জেনারেল ইয়াহিয়া খান বন্যা-নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি একমাত্র যে পদেক্ষেপের কথা ঘোষণা করেছেন তা হলো: ‘আমার নির্দেশনা অনুযায়ী পরিকল্পনা কমিশন এই কর্মসূচীতে আর্থিকভাবে সাহায্য করার জন্য বন্ধুভাবাপন্ন সব দেশ থেকে সহায়তা সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে। আমি নিশ্চিত যে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যতের জন্য জরুরি এই সমস্যা সমাধানের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিবে।’

আমন্ত্রণ

কিন্তু প্রেসিডেন্ট সমস্যার ভয়াবহতাকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে ভাবেননি। সমস্যা সমাধানে অভ্যন্তরীণ সম্পদের ব্যবহার এবং অন্তঃত বিষয়টিকে কম ধ্বংসাত্মক হবার ব্যবস্থা করা সরকারের এজেন্ডার মধ্যে আসেনি। ইয়াহিয়া খান বলেন: ‘এই উপলক্ষে আমাদের বিশেষ একটি তহবিল গঠনের ইচ্ছা আছে, বন্ধুভাবাপন্ন দেশসমূহকে এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাসমূহকে সাহায্য প্রদান করার আহ্বান জানানো হবে এবং যাতে পাকিস্তান নিজেই যথেষ্ট পরিমাণে অর্থ প্রদান করবে।’

বিশ্বসংস্থা ও দেশসমূহ ইয়াহিয়া খানের আবেদনে সাড়া দিবে কি না তা এখন দেখার বিষয়। কিন্তু পাকিস্তানের জন্য তার চাইতে বড় আকাঙ্ক্ষার বিষয়, বেসামরিক ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া — এ-মুহূর্তে সমুদ্রের জলে ভেসে গেছে।