মিটামইনের সরকারহাটির সেই ১৯৭১ সালের বীরাঙ্গনা রাসমনি দেবীর (৫০) খবর কেউ রাখে না। সহায়-সম্বলহীন রাসমনি দেবী অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর অনেক বীরাঙ্গনার খবর পত্রপত্রিকায় এসেছে। কিন্তু বিদায়ী জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতার বাড়ির পাশের বীরাঙ্গনা রাসমনি দেবীর খবর হয়তো তিনি নিজেও রাখেন না। বক্তৃতা-বিবৃতিতে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন। কিন্তু এদের কথা কেউ বলেন না। এ যেন আলোর নিচে অন্ধকার। সম্প্রতি কথা হয় রাসমনি দেবীর সঙ্গে। ১৯৭১ সালের শ্রাবণ মাসে মিটামইন সরকারহাটির মৃত রামলোচন চত্রক্রবর্তীর মেয়ে রাসমনি দেবীর বয়স যখন ১৬ বছর, তখন একই উপজেলার কাটখাল ইউনিয়নের ঢালারগাঁও ছত্রিশে এক টগবগে যুবকের সঙ্গে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী তার বিয়ে হয়। তার বিয়ের পরপরই দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। শুরু হয় পাক হানাদার বাহিনীর তান্ডবলীলা এবং ঘটতে থাকে একের পর এক বর্বরোচিত ঘটনা। তখন বর্ষাকাল। চারদিকে অথৈ পানি। ওই সময়ই তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর মেয়ে-জামাই ফিরাগমন করে জামাইয়ের নিজ বাড়ি ছত্রিসে চলে আসেন রাসমনি দেবীকে নিয়ে। চলে আসার দু’দিন পরই হঠাত দুপুরবেলায় পাক হানাদার বাহিনী ঢালারগাঁও ও ছত্রিসের প্রায় ৩ শ’ মানুষকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের সঙ্গে আরো ২০ মহিলাকেও তারা নিয়ে যায় ইটনা পাকবাহিনী ক্যাম্পে। প্রথমে যাদের ধরা হয় তাদের গুলি করে হত্যা করে। মিটামইন উপজেলায় আতপাশা ভয়রা গাছের নিচে তাদের গণকবর দেয়। আর মহিলাদের গণধর্ষণ করে ছেড়ে দেয়। সুন্দরী রাসমনি দেবী অর্থাত যিনি বীরাঙ্গনা খেতাব পান তাকে গণধর্ষণ করে নদীতে ফেলে দেয়। ইটনা থানার ছিলনী গ্রামের জেলেরা রাসমনিকে নদী থেকে তুলে বাড়িতে নিয়ে যায়। তখন তিনি অজ্ঞান ছিলেন। জেলেরা তাকে আগুনের তাপ দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে নিয়ে আসে। জ্ঞান ফেরার পর নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে তিনি মিটামইন সরকারহাটির কথা বলেন। জেলেরা তাকে মিটামইনে পৌঁছে দেয়। তার স্বামীকে পাক হানাদার বাহিনী গুলি করে হত্যা করে। এরপর থেকেই রাসমনি মিটামইনে তার পিত্রালয়ে বসবাস করতে থাকেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবল্পব্দু শেখ মুজিবুর রহমান রাসমনিকে এক হাজার টাকা প্রদান করেন এবং তাকে একটি সার্টিফিকেটও দেন। সেই থেকেই রাসমনি দেবী বীরাঙ্গনা হিসেবে পরিচিত এবং দুর্বিষহ জীবনের গ্লানি বয়ে বেঁচে আছেন। বঙ্গবন্ধুর ওই কাজের পর স্বাধীনতার ৩৬টি বছর কেটে গেল; কিন্তু কোনো সরকারই রাসমনি দেবীর খবর নেয়নি। এমনকি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন ডেপুটি স্পীকার ও পরের সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদও তার খোঁজ নেননি। বর্তমানে তিনি খুব কষ্টে তার ভাই দেবরাজ চক্রবর্তীর আশ্রয়ে আছেন। দেবরাজ পান-সুপারির ব্যবসা করে কোনোরকমে দিনযাপন করেন। এ বছর স্থানীয় ইউএনও অফিসের পিয়ন নরেশ দাস ইউএনও সাহেবকে বলে রাসমনি দেবীর জন্য বিধবা ভাতার ব্যবস্থা করে দেন। এ টাকা দিয়ে রাসমনি চলতে পারেন না। মিটামইনে এই রাসমনি দেবীর মতো অনেকেই আছেন যাদের অবস্থাও প্রায় একই রকম। রাসমনি দেবীরা আমাদের গৌরব। তাদের প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন নিজেদের দৈন্যকেই প্রকট করে তোলে। রাসমনি দেবী মুক্তিযুদ্ধের কথা উঠলেই ফিরে যান সেই দিনগুলোতে। ডুকরে কেঁদে ফেলে বিলাপ করেন, ‘আমি আবার যুদ্ধ দেখতে যাই।’
বীরাঙ্গনা রাসমনি দেবীর জীবনযুদ্ধ – বিজয় কর রতন
2 Replies